শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বিডিআর হত্যাকাণ্ড: শেখ হাসিনাকে ফোন করেও সহায়তা মেলেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক 
প্রকাশিত: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

বিডিআর হত্যাকাণ্ড: শেখ হাসিনাকে ফোন করেও সহায়তা মেলেনি
রাজধানীর পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন (ফাইল ছবি)

রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে সহায়তা চান বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান ও র‌্যাব ডিজিসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ও র‌্যাব সদস্যদের কেউ আসেনি তাদের বাঁচাতে।  

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সাড়ে তিন হাজারের বেশি পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্যও উঠে এসেছে। গত ৩০ নভেম্বর বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত কমিশন। 
 
পিলখানা দরবার হলে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার পরিস্থিতির বিবরণে তদন্ত প্রতিবেদনে আরও যা জানা গেছে—


বিজ্ঞাপন


সিপাহী মইনুদ্দিনকে নিরস্ত্র করার পর জুতার ফিতা দিয়ে বাঁধা অবস্থায় সে স্টেজের উপর শুয়ে থাকে। সবাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সে কোন কথার উত্তর না দিয়ে অজ্ঞানের মত পড়ে থাকে (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৫৫)। যে অস্ত্র নিয়ে সিপাহী মইনুদ্দিন প্রবেশ করে সেটি ছিল ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের রাইফেল এবং তাতে ৬-১০টি গুলি ভর্তি ছিল। ডিজি, বিডিআর ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শামসুল আলমকে উদ্দেশ্যে করে বলেন যে অস্ত্রটা লে. কর্নেল শামস এর ইউনিটের (সূত্র: জাতীয় কমিটির নিকট ইমাম মরহুম জনাব সিদ্দিকুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত বিবৃতি)। এ বক্তব্যের সঠিকতা অন্য কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা যাচাই করা যায়নি। সাক্ষী মৃত্যুবরণ করায় তার বক্তব্যও নেয়া সম্ভব হয়নি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সামসুল আলম চৌধুরী বিষয়টি অস্বীকার করেছেন (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-১২০)।  

আরও পড়ুন: 

‘‎বাহিনীগুলো দুর্বল করে হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করাই ছিল উদ্দেশ্য’

বিডিআর হত্যাকাণ্ডে দলগতভাবে জড়িত আ.লীগ, মূল সমন্বয়কারী তাপস: কমিশন

র-এর কিলিং গ্রুপের সঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহের পরিকল্পনা, ছিলেন সোহেল তাজও

 

এর মধ্যে দেখা যায় লাল সবুজ কাপড় দিয়ে নাক মুখ বাঁধা বিডিআর সৈনিকরা দরবার হল ঘিরে ফেলেছে এবং কিছুক্ষণ পরপর গুলি করছে (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৪৩ এবং সাক্ষী নম্বর-৫৫)। তখন দরবার হলের জানালা খুলে কর্নেল গুলজার, কর্নেল এমদাদ, লে. কর্নেল এনশাদ এবং লে. কর্নেল কামরুজ্জামান চিৎকার করে ওদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা ফায়ার করো না, তোমরা ফেরত যাও।’ এই সময় দেখা যায়, অনেক সৈনিক দৌড়ে এসে এই সকল সৈনিকদেরকে এমুনিশন সাপ্লাই দিচ্ছে। এসময় একটি পিকআপ সম্ভবতঃ সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নের রাস্তা দিয়ে দরবার হলের পাশের মাঠে এসে দাঁড়ায়। ঐ সময়ে গুলি কাঁচ ভেঙ্গে দরবার হলের ভিতরে ঢুকছিল। অফিসাররা কেউ দেয়ালের পিছনে, কেউ পিলারের আড়ালে আশ্রয় নেন (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৫৫)।  

BDR_murder_ii
রাজধানীর পিলখানায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন (ফাইল ছবি) 

 

এ সময় লে. কর্নেল কামরুজ্জামান লক্ষ্য করেন ডিজি কারো সাথে মোবাইলে কথা বলছেন। তিনি বলছিলেন, ‘৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের কিছু সৈনিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনী পাঠান।’ মোবাইলে কথা শেষ হলে ডিজি কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নূরুল ইসলামকে বলেন, ‘এসএম সাহেব, আপনি তো কোন দিন সৈনিকদের এরকম ক্ষোভ আছে, একবারও বলেননি।’ এসময় কেউ একজন ডিজিকে বললেন, ‘স্যার, গাড়ি লাগানো আছে, আপনি চলে যান।’ ডিজি বললেন, ‘আমি কোথায় যাব এবং কেন যাব’? সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকা সেক্টর কমান্ডার এবং ঢাকার অধিনায়কদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘You all rush to the unit and get back your people’ এবং সকলের সাথে কথা বলো ‘and try to motivate them’ এই কথা শোনার পর ঢাকা সেক্টর কমান্ডার ও অধিনায়কগণ দরবার হল থেকে নিজ নিজ ইউনিটে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হন’ (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৫৫)।

লে. কর্নেল শামসুল আলম চৌধুরী, লে. কর্নেল তাসনিম (সিগন্যাল সেক্টর), লে. কর্নেল এনায়েত (সিও ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়ন, মেজর শাহনেওয়াজ (আরএসইউ), মেজর হুমায়ুন (জিএসও-২) এবং মেজর দিদার দরবার হলের দক্ষিণ দিক দিয়ে বের হয়ে আসেন। ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিব, লে. কর্নেল এনায়েত সুইমিং পুলের দিকে অগ্রসর হন (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-১২০)। 

এদিকে যে অস্ত্রটি দরবারে সিপাহী মইনু্দ্দিন ডিজির দিকে তাক করেছিল, সেটি দিয়ে মেজর আজিজুল হাকিম গুলি করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু ডিজি বললেন ‘Don’t shoot’ (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৪৩)।  

সেনাপ্রধান ও ডিজি র‍্যাবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন বিডিআর ডিজি (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-০১ এবং সাক্ষী নম্বর-৫৫)। সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে মেজর জায়েদী মোবাইল ফোনে ডিফেন্স অ্যাডভাইজার মেজর জেনারেল তারেককে (যিনি পূর্বে মেজর জায়েদীর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন) ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন এবং সাহায্য প্রার্থনা করেন। অতপর ফোনটি তিনি মেজর জেনারেল শাকিলের হাতে দেন মেজর জেনারেল তারেকের সঙ্গে কথা বলার জন্য। সম্ভবত কলটি কেটে যাওয়ায় কথা হয়নি (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৮৪)। 

ইতোমধ্যে কর্নেল গুলজার জানায় যে র‍্যাবের সকলের সাথে কথা হয়েছে, তারা কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা দিবে। এর মধ্যেই ডিএমও, ব্রি. জেনা. জিয়া এবং লে. কর্নেল কামরুজ্জামানের সাথে কথা বলেন (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৫৫)। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে অফিসাররা স্টেজের ভিতরে পর্দার পিছনে যেয়ে দুই ভাগ হয়ে স্টেজের দুই পাশে আশ্রয় নেন। এক পাশে দক্ষিণ দিকে তিনজন মহিলা অফিসার, লে. কর্নেল লুৎফর রহমান খান, লে. কর্নেল রবি, লে. কর্নেল বদরুল হুদা ও মেজর জাহিদসহ আরো কয়েকজন অফিসার। অপর পাশে উত্তর দিকে ডিজি, ডিডিজি, লে. কর্নেল কামরুজ্জামান এবং আরো কয়েকজন অফিসার ছিলেন (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৬৮)। স্টেজের পর্দার ভেতরে যাবার সময় ডিওটি (কর্নেল আনিস) এবং লে. কর্নেল কামরুজ্জামান বেঁধে রাখা সৈনিকটাকে টেনে পর্দার ভিতরে নিয়ে আসেন (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৫৫)।

আনুমানিক সকাল ৯টা ৪৮ মিনিটের দিকে ডিজি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেন। তখন ডিজি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে সবাই চুপ করে থাকায় উনার কথা স্পষ্টই শোনা যায়। উনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা আপনার সরকারকে হেয় করার জন্য বিদ্রোহ করেছে। আপনি আমাদেরকে সাহায্য পাঠান। আপনি আমাদেরকে বাঁচান।’ এটা ছিল সকাল ৯টা ৪৮ মিনিটের পর (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৪২, সাক্ষী নম্বর-৫৫ এবং সাক্ষী নম্বর-৮৪)। এর পরই ডিজি অন্য কাউকে (সম্ভবত: ডিজির স্ত্রী) ফোনে বলেন ‘ভয় পেয়োনা। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রাখো’ (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৬৮ এবং সাক্ষী নম্বর-৮৪)। 

ওই সময় সেখানে অফিসারদের সাথে আটকে পড়া আরপি জেসিও তখন আস্তে আস্তে ওয়াকি টকি শুনছিলেন। লে. কর্নেল কামরুজ্জামানের কথায় সাউন্ড বাড়িয়ে শোনা গেল, অপর পাশ থেকে বলছে, ‘অফিসার মেসে অফিসারদের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বিডিআরের সব গেইট এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা এবং কোত ভেঙ্গে অস্ত্র গোলা বারুদ নিয়ে যাচ্ছে।’ এর মধ্যে দেখা গেল এডিসি (ক্যাপ্টেন মাজহার) কেঁদে কেঁদে কারো সাথে মোবাইলে কথা বলছে। তাকে জিজ্ঞেস করাতে জবাব দিল, ‘রাইফেল ভবনে বিদ্রোহী বিডিআররা ঢুকেছে। হাউজ গার্ড অনেক আগে চলে গিয়েছে। ম্যাডাম বলছেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।’ ডিজি বিষয়টি শুনে বললেন ‘ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে থাকতে বলো’ (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৫৫)। 

গুলির শব্দ যখন আরো কাছে মনে হচ্ছিল, তখন ডিজি স্টেজের সব আলো নিভিয়ে ফেলতে বলেন। কর্নেল আনিস একটি লম্বা কাঠ দিয়ে সব বাল্ব ভেঙ্গে ফেলেন। মাইকে ডিজি সবাইকে শান্ত হতে বলছিলেন। বলছিলেন, ‘তোমরা গুলি থামাও, তোমাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে।’ এই সময়, একজন সৈনিক দৌড়ে পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে, ওর হাতে বা কাঁধে গুলি লেগেছিল। একজন আরটি ভিতরে ছিলেন, তার পাগড়ির কাপড় দিয়ে একজন তার ক্ষতস্থান বেঁধে দেয় (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৬৮)। 

ডিজিসহ কয়েকজন অফিসার স্টেজের পর্দার ভিতরে উত্তর দিকের উইং এ অবস্থান নিয়েছিলেন। কর্নারে একটি চেয়ারে ডিজিকে বসানো হল, বাকিরা সবাই ডিজির গা ঘেঁষে দাঁড়ান। ডিজি বললেন ‘তোমরা মৃত্যুকে কেন ভয় পাচ্ছো? মরতে তো একদিন হবেই।’ অফিসাররা বললেন ‘স্যার আপনার সেফটির দরকার আছে।’ ডিজি তখন বললেন, ‘র‍্যাব বা সেনাবাহিনী কেউ এখনও এলো না?’ ওই সময় কর্নেল মসিউর ডান দিকের উইং থেকে দৌড়ে বাম দিকের উইং এ চলে এলেন। বাম উইং এর বামে অবস্থিত সিঁড়িতে ডিডিজি ছিলেন। ডিডিজি এবং কর্নেল মসিউর দু’টি সাউন্ড বক্স ওখানকার পেছনের দরজার সামনে একটার উপর একটা রাখেন, তবে ডিডিজি বলেন সাউন্ড বক্স গুলি ঠেকাতে পারবে না (সূত্র: সাক্ষী নম্বর-৫৫)।

চলবে…

ক.ম/ 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর