আগুনে পুড়ে বিধ্বস্ত হাজারও ঘর। বাতাসে পোড়া টিন আর প্লাস্টিকের গন্ধ। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে সালাম মিয়ার চোখ শুধু ঘোরে ছাই–গাদা আর টিনের মোচড়ানো টুকরোর দিকে। একসময় এখানে ছিল তার ছোট্ট মনিহারী দোকান—পরিবারের একমাত্র অবলম্বন।
‘আমার দোকানের আয়ে পুরো পরিবার চলত। আগুনে সব পুড়ে গেছে’—সালাম মিয়া বলতে বলতে থেমে গেলেন। বাকিটা বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেল।
বিজ্ঞাপন

দুই বছর ধরে কোনোমতে দাঁড় করানো দোকানটিতে ছিল কসমেটিকস, চিরুনি, নিত্যপণ্য—টুকিটাকি জিনিস। প্রতিদিনের সামান্য আয়েই চলত পাঁচ সদস্যের সংসার। স্থিরতা ছিল, নিয়ম ছিল, নিরাপত্তা ছিল। এখন সেই জায়গায় পড়ে আছে শুধু খালি টিনের বাক্স আর গলে যাওয়া প্লাস্টিকের বোতল।
সালাম মিয়া বললেন, ‘পুঁজি নেই। ধার পাব কি না জানি না। পরিবারের দিকে তাকালে বুকটা মুচড়ে ওঠে। কোথা থেকে আবার শুরু করবো?’
‘আমার একটা মনিহারী দোকানের আয়ে পুরো পরিবার চলতো। আগুনে দোকানের সব পুড়ে গেছে’ এই কথাটার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক মানুষের জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর গল্প।
বিজ্ঞাপন
বহু বছর ধরে এই মনিহারী দোকানটিই ছিল তার সংসারের একমাত্র ভরসা। প্রতিদিন সকালে দোকান খুলে বসা, গ্রাহক আসা–যাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামান্য লাভ এসব দিয়েই কোনোভাবে চলে যেত পরিবারের খরচ। হয়তো বেশি আয় হতো না, কিন্তু স্থিরতা ছিল, নিরাপত্তা ছিল, মাসের শেষে কোনোরকমে হলেও বাড়িভাড়া, খাবার আর বাচ্চাদের খরচ চলে যেত।

তিনি বললেন, দোকান তোলার মতো পুঁজি নেই, ধার নেওয়ার মতো স্থায়ী কোনো নিশ্চয়তাও নেই। প্রতিদিন পরিবারের দিকে তাকালে মনটা ভেঙে যায়। সেই দোকানই ছিল আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন, এখন সেটাই হারিয়ে ফেলেছি। কীভাবে আবার শুরু করব তা বুঝে উঠতে পারছি না।
রাজধানীর কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ড তাদের শুধু ঘর নয়, প্রতিদিনের আয়–রোজগারের ভরসাটুকুও কেড়ে নিয়েছে। ছোট দোকান, সেলাই মেশিন, ভ্যানগাড়ি বা রাস্তার খাবারের স্টল যেসব সামান্য পুঁজিতে জীবন চলছিল, আগুনে সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন নতুন করে শুরু করার পথ খুঁজছেন জীবিকা হারানো মানুষরা।
পোড়া ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে বেড়ানো সেই জায়গার এক কোণে বসে ছিলেন দোকানি সালাম মিয়া। তিনি বললেন, তার কসমেটিকস আর নিত্যপণ্যের ক্ষুদ্র দোকানটি মাত্র দুই বছরে দাঁড় করিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর হাতে রয়েছে খালি টিনের বাক্স আর কিছু গলে যাওয়া বোতল।
তিনি বললেন, তার পরিবারে পাঁচজন সদস্যের সংসার এখন পুরোপুরি থমকে গেছে। প্রতিদিনের লাভ–খোরাক ছিল তার পরিবারের ভরসা, এখন তিনি জানেন না কোথা থেকে উঠে দাঁড়াবেন। সাহায্য না পেলে দোকান নতুন করে গড়ে তোলা তার পক্ষে অসম্ভব।
একই হতাশা সেলাই–মেশিন হারানো রাবেয়া খাতুনের চোখেও। ঘরের কোণে রাখা তার দুটি সেলাই মেশিনই ছিল আয় করার একমাত্র পথ। আগুনে সেগুলো পুড়ে যাওয়ার পর তিনি এখন অন্যের দেওয়া পুরোনো কাপড় থেকে যা জোটে, তা দিয়ে বাচ্চাদের পরতে কিছু বানিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। রাবেয়া বললেন, সেলাই মেশিন ফিরে না পেলে তিনি আর কাজ শুরু করতে পারবেন না। তিনি জোর দিয়ে বললেন যে তার গ্রাহক ছিল প্রচুর, ঈদ–পূজা বা বিয়েতে ব্যস্ত সময় কাটত। এখন সবই থেমে গেছে।
অগ্নিকাণ্ডে পুরো স্টল হারিয়েছেন আব্দুল গফুর। ফুটপাতে তিনি প্রতিদিন গরম খাবার বিক্রি করতেন। আগুন তার রান্নার চুলা, হাঁড়ি, তেল–মশলা সবকিছুই কেড়ে নিয়েছে। এখন তিনি জায়গাটায় দাঁড়িয়ে শুধু পোড়া চুল্লির ছাই দেখেন। বললেন, আবার স্টল তুলতে গেলে অন্তত যে মূলধন প্রয়োজন, তা তার কাছে নেই। তার পরিবারের খাবার জোগাড় করতেই এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কড়াইলের এই জীবনের গল্প হাজারো মানুষের একই চিত্র তুলে ধরে। অগ্নিকাণ্ডে শুধু ঘর নয়, জীবিকার শেকলটাও ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রত্যেকে নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন দেখছেন, কিন্তু সে স্বপ্ন এখন আটকে আছে সামান্য মূলধন, সামান্য সহায়তা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝখানে।
এম/এআর

