- ১৯৫০-এর দশকে মওলানা ভাসানীর হাত ধরে চীনের সঙ্গে প্রথম সখ্যতা
- স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ
- প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সফরে সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন মাত্রা
- তিস্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীন, উন্মোচিত হচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু চীন। ১৯৫০-এর দশকে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে চীনের সঙ্গে প্রথম সখ্যতা শুরু হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এবার দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গতি পাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
গত কয়েক মাসে প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধানসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চীন সফর সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অর্থনীতি, পানি সম্পদ, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে কৌশলগত নিরাপত্তা প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব দৃঢ় হচ্ছে। বিশেষত তিস্তা নদী ও ঢাকার নদীগুলোর দূষিত পানি পরিশোধ, নতুন হাসপাতাল স্থাপনা, উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প এবং বিনিয়োগ-সুবিধার মাধ্যমে দেশের জনগণকে ‘জনসম্পদে’ রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে।
চীনের সঙ্গে এই সম্পর্কন্নোয়ন দেশের বিপুল জনগোষ্ঠিকে জনসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার অভিপ্রায় হিসেবে দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর, সম্পর্কে নতুন মাত্রা
চলতি বছরের ২৬-২৯ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীনের হাইনান প্রদেশে অনুষ্ঠিত বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২৮ মার্চ তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এবং বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করেন।
বিজ্ঞাপন
বোয়াও সম্মেলনে মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য এশিয়ার নেতাদের সহযোগিতা কামনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে বাংলাদেশের বেশকিছু বড় অর্জন রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০২৮ সাল পর্যন্ত চীনে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে; যা বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পর দুই বছর পর্যন্ত বহাল থাকবে। চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়েছেন, এটি ড. ইউনূস সরকারের জন্য একটি সুখবর। চীন সরকার ও সেদেশের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এছাড়া দেশটির ৩০টি কোম্পানি চট্টগ্রামের অনোয়ারায় চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ, বহুল প্রতিশ্রুত তিস্তা প্রকল্পে সহায়তাসহ বাংলাদেশের নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছে বাংলাদেশ।
প্রধান উপদেষ্টার ওই সফরে একটি চুক্তি ও আটটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যসেবা খাত। চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদের হার ১-২ শতাংশ হ্রাস করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা চীনের তৈরি পোশাক কারখানা, বৈদ্যুতিক যানবাহন, হালকা যন্ত্রপাতি, উচ্চ প্রযুক্তির ইলেকট্রনিকস, চিপ উৎপাদন এবং সৌর প্যানেল শিল্প বাংলাদেশে হস্তান্তর সহজ করতে বেইজিংয়ের সহায়তা চেয়েছে। এ বিষয়ে চীন ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছে। এটি যদি সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশে চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং হাব তৈরি হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে বাংলাদেশ এক চীননীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
চীনের সঙ্গে অন্য যেকোনো দেশের সম্পর্ক গড়ার এবং রক্ষায় চীনের এক চীননীতিকে সমর্থন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে চীন অনেক রক্ষণশীল।
সেনাপ্রধানের চীন সফর
গত ২০ আগস্ট সরকারি সফরে চীনে যান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সফর শেষে গত ২৭ আগস্ট রাতে দেশে ফেরেন তিনি।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই সফরে সেনাপ্রধান পিপলস লিবারেশন আর্মির স্থল বাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশার জেনারেল চেন হুইসহ উচ্চপদস্থ চীনা সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। গত ২২ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান পিপলস লিবারেশন আর্মির সদর দপ্তরে পৌঁছলে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে সেনাবাহিনী প্রধান পিপলস লিবারেশন আর্মির স্থল বাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশার জেনারেল চেন হুইয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তারা দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা, জনগণের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনে সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের সামরিক শিল্পের উন্নতিতে চীন কর্তৃক প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের বিষয়েও আলোচনা করা হয়।
গত ২৩ আগস্ট সেনাবাহিনী প্রধান চীনের নোরিনকো গ্রুপের প্রেসিডেন্ট চেন ডেফাঙয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রচলিত নোরিনকো গ্রুপের বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জামের আপগ্রেডেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়েও ওই বৈঠকে আলোচনা করা হয়।
সেনাপ্রধান পিপলস লিবারেশন আর্মির একাডেমি অব আর্মড ফোর্সেসের বেইজিং ক্যাম্পাসের প্রশিক্ষণ সুবিধাদিসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন গবেষণাগার পরিদর্শন করেন।
সফরকালে সেনাবাহিনী প্রধান বেইজিং ও শিয়াংয়ে অবস্থিত নোরিনকো গ্রুপের বিভিন্ন কারখানা ও গবেষণাকেন্দ্র, চায়না এরোস্পেস লং মার্চ ইন্টারন্যাশনাল কো. লি. এবং অ্যাইশেঙ ইউএভি ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির কারখানা পরিদর্শন করেন।
বিএনপি নেতাদের চীন সফর
২২ জুন রাতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীন যান। প্রথমে তারা বেইজিং গ্রেট হলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। চীনের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী সান ওয়েইডং, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও এবং ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান লি হংঝং এর সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে এসব বৈঠকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহ উল্লাহ, সুকোমল বড়ুয়া, জহির উদ্দিন স্বপন, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল ও চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার ছিলেন।
চীন সফর শেষে ২৭ জুন রাতে দেশে ফেরার পর মির্জা ফখরুল বলেন, চীন সফরের মধ্য দিয়ে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে। আমাদের এই সফরটা ছিল রাজনৈতিক। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। আমাদের এই সফরটা সফল হয়েছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত সফল ও ফলপ্রসূ মিটিং হয়েছে। পার্টি টু পার্টি সম্পর্ক আরও নিবিড়-শক্তিশালী হয়েছে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে তারা দাওয়াত করেছেন এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা খুশি হয়েছেন যে তিনি এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরাও তাদের দাওয়াত করেছি.. তারা তা গ্রহণ করেছেন। বিএনপি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দুই বছরের মধ্যে একটা রাজনৈতিক ডায়ালগের জন্য দুই দলের মধ্যে একটা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করারও আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা অভিভূত হয়েছি যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং -এর নেতৃত্বে কয়েক বছরের মধ্যে চীন একটা উঁচু পর্যায়ে পৌঁছে গেছে । তার সমস্ত অনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে। আমি মনে করি এটা বাংলাদেশের জন্য নয়, সমস্ত বিশ্বের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জামায়াত নেতাদের চীন সফর
প্রথমবারের মতো চীন সফর করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল। গত ১০ জুলাই রাতে প্রতিনিধি দল নিয়ে চীনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন জামায়াত আমীর।
১৫ জুলাই রাতে ঢাকায় ফেরার পর জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, চীনের গুরুত্বপূর্ণ নগরী সাংহাই সফরে প্রাদেশিক সরকারসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও থিংক ট্যাংকের বৈঠক হয়েছে। সফরটি ছিল মূলত: সেন্ট্রাল কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না-সিপিসি-এর আমন্ত্রণে। সিপিসির লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯২১ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রথম বৈঠকটি ছিল ১৩ জন নিয়ে এই সাংহাইতেই। সেখানে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য প্রবেশ করায় সেই সভাটি নৌকাতে গিয়ে শেষ করতে হয়েছিল। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তারা দেশ শাসন করছে।
শফিকুর রহমান বলেন, শেষ ৩৫ বছরে চীনের এই অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। এটা তারা কীভাবে সম্ভব করেছেন, সেটা জানার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি সভাই অত্যন্ত হৃদতাপূর্ণভাবে হয়েছে। তারা বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’-এর মধ্যেই এখন সীমাবন্ধ নয়, এটা এখন প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক হয়েছে।
জামায়াত আমীর বলেন, দুই দেশের সর্ম্পক রাষ্ট্র-টু-রাষ্ট্র এর পাশাপাশি পার্টি-টু-পার্টি করতে হবে। সেটা শুধুমাত্র একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সকল দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
শফিকুর রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। চলতি বছর এই সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি হয়েছে। ৫০ বছরের বন্ধুত্বের বার্তা তাদের পৌঁছে দিয়েছি। চীনের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় চীনের প্রেসিডেন্টকে এই দেশে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
শফিকুর রহমান উল্লেখ করেন, আগামী দিনে আমাদের আসা-যাওয়া আরো বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, চাইনিজ ভাষা শেখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্নার খোলা হয়েছে। আগামী বছর এই কর্নার আরো ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করার আহ্বান জানিয়েছি। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সফরে বিমানবন্দরে এসে বিদায় জানানো ও আসার পর স্বাগত জানাতে আসার জন্য চীনের রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জানান।
এনসিপি নেতাদের চীন সফর
চীন সরকারের আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সফরে গত ২৬ আগস্ট দেশটিতে যান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল। গত ৩১ আগস্ট রাতে দেশে ফেরেন তারা। এ সময় নাহিদ ইসলাম চীন সফরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য চীনের সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
সফরে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সংস্কার স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য তারা তাদের আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। তিস্তায় যুক্ত হচ্ছে চীন-বাংলাদেশে তিস্তা নদীসহ পানিসম্পদ খাতের সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হচ্ছে চীন। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা অভিন্ন নদী যমুনার উজানে পানিপ্রবাহের বিষয়ে তথ্য দেবে দেশটি।

তিস্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীন, নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন
চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা চীনের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করে বলেন, চীন কিছু কঠিন পানি সমস্যার সমাধানে অসাধারণ কাজ করেছে। দেশটির মতো আমাদেরও একই সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা প্রণয়নে আপনাদের সহায়তা প্রয়োজন। এ সময় বিশেষভাবে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা এবং ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষিত পানি পরিষ্কারে চীনের সহায়তা চান তিনি।
সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ; আমাদের দেশে শত শত নদী রয়েছে। পানি আমাদের জীবন-জীবিকার মূল, কিন্তু কখনও কখনও এটি শত্রুতে পরিণত হয়। এখন যেহেতু জনসংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই এটি বাস্তুতন্ত্রের জন্য কী ধরণের ক্ষতি করতে পারে সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
চীনকে পানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ কারিগর হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে। প্রধান উপদেষ্টা পানি ব্যবস্থাপনায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভিশন বাংলাদেশের সঙ্গে শেয়ার করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা এখানে আপনার কাছ থেকে শিখতে এসেছি: কীভাবে আমরা পানি সম্পদকে মানুষের জন্য উপযোগী করে তুলতে পারি।
পানি ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করতে চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, চীন এক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ। বাংলাদেশ এ বিষয়ে অনেক কিছু শিখতে চায়। কীভাবে পানিসম্পদ জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি তা শিখতে এসেছি। এ সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পানি ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশকে জানানোরও আহ্বান জানান তিনি।
নদী দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উন্নয়নের চাপে মানুষ নদীর পাশের জমি দখল করছে। এছাড়া নদীগুলোর মাঝখানে পলি জমে নতুন ভূমি তৈরি হচ্ছে। যা কখনও কখনও নদীগুলোকে সংকুচিত বা মৃত করে দিচ্ছে।
বৈঠকে চীনের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গুয়োইং পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
স্বাস্থসেবায় চীনের সহযোগিতা
বাংলাদেশে চীনের সহায়তায় তিনটি বড় হাসপাতাল তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এরমধ্যে নীলফামারীতে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল, চট্টগ্রামে একটি জেনারেল হাসপাতাল ও ঢাকায় একটি পুনর্বাসন হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, নীলফামারীতে তিস্তা প্রকল্পের কাছে ১ হাজার শয্যাবিশিষ্ট একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মিত হবে। এ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য নীলফামারী মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি ১৬ একর জায়গা প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। ‘চট্টগ্রামের দক্ষিণ কর্ণফুলীতে ৫০০ থেকে ৭০০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতালের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হবে।’-বলেন তিনি।
এছাড়া ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাইয়ে বিভিন্ন আহত-প্রতিবন্ধী রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য ১০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি রিহ্যাবিলেটেশন হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে চীন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘চীন আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে চায়, তাদের যথেষ্ট আগ্রহ আছে। তবে সবকিছু এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তারা নিজেরা বিনিয়োগ করবে, ক্রাইটেরিয়া ঠিক করবে। কারিগরি প্রশিক্ষণ ও জনবল নিয়ে এখনও কোনো কথা হয়নি।’
এর আগে একই সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশটির সরকার এদেশের মানুষকে ১ হাজার শয্যাবিশিষ্ট বিশেষায়িত হাসপাতালটি উপহার হিসেবে দিচ্ছে। চীনের সহায়তায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক বিএসএমএমইউ) রোবোটিক ফিজিওথেরাপি সেন্টার স্থাপন করা হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১২০০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান দিয়েছে চীন। চীনা এ অনুদানের ৯০ শতাংশই মিলেছে স্বাস্থ্যখাতে। চীনে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার দ্বার উন্মোচন বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে চায় চীন। চীনের কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতালকে বাংলাদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে সেদেশের সরকার। এরই মধ্যে বাংলাদেশের রোগী, চিকিৎসক, পর্যটন প্রতিষ্ঠানসহ চিকিৎসা খাতের একটি দল চীনের কুনমিং ঘুরে এসেছে।
চীনে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার দ্বার উন্মোচন
দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের দেশের বাইরে সবচেয়ে স্বস্তির গন্তব্য ছিল ভারত। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে পুরনো সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়, যার প্রভাবে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ায় কড়াকড়ি আরোপ করে ভারত। সীমিত পরিসরে চিকিৎসা ভিসা দিলেও তাতে অস্থিরতা দূর হচ্ছে না। এমন সুযোগে চীন সরকার এগিয়ে আসায় বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য দেশটি ভালো গন্তব্য হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় চীনের তিনটি সরকারি এবং একটি বেসরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশিদের চিকিৎসার জন্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতালগুলো হচ্ছে, দ্য ফার্স্ট পিপলস হসপিটাল অব ইউনান প্রভিন্স, দ্য ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হসপিটাল অব কুনমিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, চায়নিজ একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সেসের ‘ফাওয়াই ইউনান হসপিটাল’ এবং ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ মেডিকেল হসপিটাল (টিএমসি)। সেখানে চিকিৎসা সুবিধা দেখতে গত ১০ মার্চ বাংলাদেশি রোগীদের প্রথম দল কুনমিং যায়। ওই দলের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন চিকিৎসক, ট্র্যাভেল এজেন্ট, সাংবাদিকরাও।
ঢাকায় বিশাল বাংলাদেশ-চীন বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলন গত জুন মাসে চীনা বিনিয়োগকারী ও কোম্পানির প্রতিনিধি নিয়ে বাংলাদেশ চায়না ইনভেস্টমেন্ট এন্ড ট্রেড কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ১ জুন ঢাকার বিনিয়োগ ভবনে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টো মুহাম্মদ ইউনূস এবং চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনথাও।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত এই সম্মেলনে চীনের ১০০টি কোম্পানির প্রায় ২৫০ জন প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ফরচুন ৫০০ তালিকাভুক্ত ছয়-সাতটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছিলেন।
এ ছাড়া চীনের চারটি শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিনিধিরাও এতে যোগ দেন। এসময় এদেশে পাট ও পাট জাতীয় পণ্যের সম্ভাবনা ও বিনিয়োগে আগ্রহের কথা তুলে ধরেন চীনের ব্যবসায়িরা। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা এদেশের সমৃদ্ধশীল জামদানি ও মসলিন শিল্পের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন
চলতি অক্টোবর মাসে চীনের বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি বর্ণাঢ্যভাবে উদযাপিত হয়েছে। বেইজিংয়ের স্থানীয় এক হোটেলে আয়োজিত কূটনৈতিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্ত ছিল চাইনিজ পিপলস অ্যাসোসিয়েশন ফর ফ্রেন্ডশিপ উইথ ফরেন কান্ট্রিজ (সিপিএএফএফসি)। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্ট্যান্ডিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান লুওসাং জিয়াংছুন। এতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, চীনা সরকারি কর্মকর্তা, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যম প্রতিনিধি ও প্রবাসী বাংলাদেশিরাও অংশ নেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্যে দুই দেশের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন এবং ভবিষ্যতে কৌশলগত সহযোগিতা আরও জোরদার করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
নতুন বিনিয়োগ আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের সঙ্গে আমদানির পাশাপাশি সেখানকার বাজারে প্রবেশের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘চীন বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী। তারা বাংলাদেশের অনেক বড় বড় অকাঠামো নির্মাণ করছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই আমরা অনেক বড় বড় বিনিয়োগ পাচ্ছি। এখন চীন থেকে আমাদের আরও নতুন নতুন বিনিয়োগ আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কর্ণফূলীর ওপারে চীনের স্পেশাল ইকোনোমিক জোন হওয়ার কথা ছিল যা দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে, ৮-১০ বছর ধরে যার কোনো অগ্রগতি নাই। যার টানেলও ইকোনোমিকালি ভায়াবল হচ্ছে না। এখন সে বিষয়ে আলোচনা জোরদার করতে হবে। এখন চীনের সঙ্গে বিনিয়োগ সম্পর্কটা অনেক বেশি শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের আমদানির পাশাপাশি চীনের মার্কেটে প্রবেশের বিষয়টিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা চীনে যে সফর করেছেন আমি মনে করি, অত্যন্ত ভালো একটা সফর হয়েছে। যদিও সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের কথা বলা হয়নি, কিন্তু যৌথ বিবৃতি থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু প্রকল্পে সহযোগিতা করবে চীন। যেমন দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগ অবকাঠামোতে সুনির্দিষ্টভাবে বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করা না হলেও যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে বিআরআইয়ের আওতায় দুই দেশ সহযোগিতা এগিয়ে নিয়ে যাবে।
‘যৌথ বিবৃতির এই অংশ রেল যোগাযোগ অবকাঠামোর বিষয়টি এসে যায়। চীনের সঞ্চিত অর্থের অভাব নেই। সেই অর্থটা তারা বিনিয়োগ করতে চায়। চীনের সঙ্গে এ ব্যাপারে যে আলোচনা হয়েছে তাতে বোঝা যায়, বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে চীন অত্যন্ত ইতিবাচক।’
টিএই/এমআর

