দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরিত করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন দেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ। সুজনের নাগরিক সংলাপ ও বিস্তৃত জনমত জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই জরিপটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) রাজধানীর সিরডাপের এ টি এম শামসুল হক মিলনায়তনে সুশাসনের জন্য নাগরিক— সুজন কতৃক আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপের মূল প্রবন্ধে এসব উঠে আসে। সুজনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় কমিটির সদস্য মো. একরাম হোসেন।
বিজ্ঞাপন
প্রবন্ধে উঠে আসে, নাগরিকরা দৃঢ়ভাবে মনে করেন, দুর্নীতি মোকাবিলায় দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এটি কমিশনকে রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত রাখবে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জরিপ ও সংলাপে অংশ নেওয়া নাগরিকদের একটি বড় অংশ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুদক’র কার্যক্রম অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে থাকে। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর কমিশন স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে এবং দুর্নীতি দমন কার্যক্রম আরও কার্যকর হবে।
সংলাপে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরিত হলে দুদককে পার্লামেন্ট বা সরকারের সরাসরি নির্দেশের বাইরে রাখা সম্ভব হবে। ফলে দুর্নীতি দমন শুধু অনুসন্ধান বা অভিযোগ সমাধানে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি স্থায়ী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারবে।
নাগরিকদের মধ্যে অনেকে মনে করেন, শুধুমাত্র শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার মাধ্যমে দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে কমিশনের নীতি-নির্ধারণ, বাজেট ও পরিচালনায় সরকারি হস্তক্ষেপ কমানো সম্ভব হবে।
বিজ্ঞাপন
এই প্রস্তাবনা সংসদে উপস্থাপন করলে দেশের সকল রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। সুজনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধন, গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনসহ বিভিন্ন বিকল্প পথ বিবেচনা করা যেতে পারে।
সংলাপে বক্তারা আরও বলেন, দেশের মানুষ পরিবর্তন চায় এবং তা কার্যকরভাবে রূপায়িত করতে হলে দুদকের স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো আরও শক্তিশালী হবে এবং দুর্নীতি কমানোর পথে বড় ধাপ নেওয়া সম্ভব হবে।
সুজনের প্রবন্ধে উঠে আসে, নাগরিকদের মতামত আমাদের নির্দেশিকা। ৯০ শতাংশের সমর্থন একটি সুস্পষ্ট বার্তা যে, জনগণ প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠানের স্বনির্ভরতা চাইছে। আমরা রাজনৈতিক দল ও সরকারকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করব।
নাগরিক সংলাপ ও জরিপ থেকে প্রাপ্ততথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রশাসনিক সংস্কারে দুদকের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। সুজন জানিয়েছে, তারা সকল রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ চালিয়ে প্রস্তাবিত সংস্কার কার্যকর করার চেষ্টা চালাবে।
উল্লেখ্য, মতামত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ বছরের গত ২৯ মে থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সুজন প্রণীত প্রস্তাবিত জাতীয় সনদ চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে ৬৪টি জেলার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে সারাদেশে ১৫টি নাগরিক সংলাপের আয়োজন করা হয়। এর পাশাপাশি একই সময়ে সংস্কার বিষয় ৪০টি প্রশ্ন নিয়ে একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করে সুজন। এতে দেশের সব জেলার মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে।
জরিপে অংশ নেন ১ হাজার ৩৭৩ জন। এর মধ্যে নারী ৩৩৫, পুরুষ ১ হাজার ৩৩ এবং তৃতীয় লিঙ্গের রয়েছেন পাঁচজন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ২৬ জুলাই জাতীয় পর্যায়ে আরও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানসমূহে উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মতামত ও জনমত জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত খসড়া জাতীয় সনদটি চূড়ান্ত করে ৪ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে পেশ করা হয়।
এএইচ/এফএ

