জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আদলে বাংলাদেশ ‘ইলেকশন সার্ভিস কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে ‘সম্ভাব্যতা যাচাই ও সুপারিশ প্রণয়নে’ সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশের মধ্যে এটি দ্রুত বাস্তবায়নের কথা থাকলেও তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
বর্তমানে জনবল পূরণে পিএসসির (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) সহায়তা নিয়ে থাকে ইসি। এক্ষেত্রে ইসি কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হতে পারলেও সচিব আসে সরকার থেকে। এছাড়া অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবের ফাঁকা পদগুলোও সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার আইন শাখার কর্মকর্তাদের প্রেষণে আনা হয় জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে। নির্বাচনের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন সরকারের কর্মকর্তারাই। ইসি কর্মকর্তারা কেবল সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন। ফলে তাদের দ্বারা ভোটে হস্তক্ষেপের সুযোগ থেকে যায়। সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্যই মূলত ‘ইলেকশন সার্ভিস কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
আইন মন্ত্রণালয় ও ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আলাদা সার্ভিস গঠনের জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন তৈরির কথা বলা হয়েছিল এবং এটি দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নাসির উদ্দিন কমিশন একমত প্রকাশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। এরপর আইন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত চাইলে মন্ত্রিপরিষদের বিভাগ একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে যাচাইয়ের জন্য কমিটি গঠন করে। সে কমিটি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে জন্য আলাদা সার্ভিস কমিশন গঠনের ‘নির্বাচন কমিশন সার্ভিস’ গঠনের বিধান অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা আরও যাচাইয়ের ওপর মত দেয়।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে ইসি কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন কমিশন যেখানে এ বিষয়ে একমত, সেখানে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কীভাবে এ বিষয়ের যৌক্তিকতা আরও যাচাই করতে হবে বলে মত দেয়। অথচ এটি এখনই বাস্তবায়নের সময়। কারণ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েক মাস।
জানা যায়, আইন মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মতামত চাওয়া হয়। এই মতামত প্রদানের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মন্ত্রিসভা ও রিপোর্ট অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইয়াসমিন বেগম নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, সভায় বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে কমিশনের প্রশাসনিক কাঠামোর স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা জরুরি। এজন্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ২০০৯ সালের নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন সংশোধনের প্রয়োজন। সে অনুযায়ী কমিশন সচিবালয় থেকে প্রেরিত খসড়ার ভিত্তিতে ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া ও তুলনামূলক বিবরণী প্রস্তুত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষার আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
সূত্রটি আরও জানায়, সভায় প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে আলোচনা করে কমিটি কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে— রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ অনুযায়ী কোনো মন্ত্রণালয়ে নতুন পদ সৃষ্টি, দফতর পুনর্গঠন বা নতুন সার্ভিস গঠন করতে হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, কাঠামো পরিবর্তন, নতুন ইউনিট বা দফতর গঠন কিংবা পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত শুধু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত হবে। এছাড়া, অধ্যাদেশে ‘নির্বাচন কমিশন সার্ভিস’ গঠনের বিধান অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা আরও যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের সবশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মন্ত্রিসভা ও রিপোর্ট অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইয়াসমিন বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এগুলো তো গোপনীয় বিষয়। আপনাদের বলার বিষয় নয়। যে মন্ত্রণালয়ের আইন সেই মন্ত্রণালয় এটা বলবে। এটা ক্যাবিনেটের কোনো আইন না।’
এ প্রসঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য আব্দুল আলীম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যদি কেউ ইসির আলাদা সার্ভিস কমিশন গঠনের প্রয়োজন নেই বলে মনে করে থাকেন, তাহলে উনি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। কারণ আমরা ইলেকশন কমিশনের প্রকৃত স্বাধীনতা চাই। আপনি ধরেন, জুডিশিয়াল সার্ভিস ওদের তো একটা সার্ভিস আছে। যাতে করে এই জুডিশিয়ারি এবং নির্বাচন কমিশন সরকারের যে সংস্থাগুলো আছে, বিশেষ করে প্রশাসন তাদের ওপরে নির্ভরশীল যাতে না হতে হয়।’
আব্দুল আলীম বলেন, ‘এন্ট্রি লেভেল থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনের সচিব পর্যন্ত তারাই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকলে কিন্তু তাদের এক ধরনের জবাবদিহিতা থাকবে। আপনি যদি বিভিন্ন কর্মকর্তাকে, বিশেষ করে সচিব, অতিরিক্ত সচিব এদেরকে এডমিন থেকে নিয়ে আসেন এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তারা আবার এডমিনে ফিরে যায়, তখন সে নির্বাচন কমিশনকে ‘ওন’ করবে না। ভাববে না যে, নির্বাচন কমিশন আমার। অনেক ক্ষেত্রে অনেক সচিব হয়ত সরকারের বা ক্ষমতাসীন দলের একটা মিশন নিয়েও আসতে পারে, তা বাস্তবায়নের জন্য। এজন্যেই এই সমস্ত নিয়োগটা এরকম একটা সার্ভিস নিয়ে হওয়া উচিত। যাতে করে সরকারের কোনো ইন্টারভেনশন অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের যে সরকারের মধ্যে থাকবে তাদের কোনো ইন্টারভেনশন না থাকে। এজন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।’
এমএইচএইচ/জেবি

