শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

৭১ ইস্যুতে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল পাকিস্তান, ইতিহাস কী বলে?

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০২:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

৭১ ইস্যুতে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল পাকিস্তান, ইতিহাস কী বলে?
৭১ ইস্যুতে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল পাকিস্তান, ইতিহাস কী বলে?

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আজও বাঙালির হৃদয়ে তীব্র ব্যথার সৃষ্টিকরে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যখন নিজেদের অধিকারের দাবিতে সড়কে নেমেছিল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্মম দমন-পীড়ন চালায়। গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন ও বেয়নেটের আঘাতের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ভয়াবহ অধ্যায় রচনা করে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জন হয়। সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ।

সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন। তিনি বলেন, একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান দুইবার ক্ষমা চেয়েছে। আর এ বিষয়ে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ‘দুইবারই নিষ্পত্তি’ হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ইসহাক দার বলেন, প্রথমবার বিষয়টির নিষ্পত্তি হয় ১৯৭৪ সালে, ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে। দ্বিতীয়বার, বিষয়টি সমাধান করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ। তিনি ঢাকায় এসে প্রকাশ্যে, খোলামনে দুঃখপ্রকাশ করেন।

তার মতে, এই দুটি ঘটনা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যথেষ্ট স্পষ্ট বার্তা দেয়। ইসহাক দার আরও বলেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তিটি দুই দেশের জন্য ঐতিহাসিক দলিল। বিষয়টি এখন অতীত, আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

তবে বাংলাদেশ এখনও এই ইস্যুকে পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়েছে বলে মনে করে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য সেই ইঙ্গিতই বহন করে। তিনি বলেন, আমরা বৈঠকে অমীমাংসিত ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে জানিয়েছি। তবে আমরা এবং পাকিস্তান উভয়েই এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি হয়েছি।

তথ্য বলছে, ১৯৭৪ সালের ১০ এপ্রিল দিল্লিতে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান অংশ নেয়। ওই চুক্তির মাধ্যমে ‘১৯৭১ সালের যেকোনো অপরাধের জন্য গভীরভাবে দুঃখপ্রকাশ’ করে পাকিস্তান। সে সময় চুক্তিতে ১৯৫ পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগকে ‘নিন্দনীয় অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর মানবিক বিবেচনায় তাদের বিচার স্থগিত করা হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

আরও পড়ুন

একাত্তর ইস্যুতে যা বললেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সে সময় একটি বার্তা দেন। তিনি বলেন, ‘অতীত ভুলে নতুন করে শুরু করুন।’ শেখ মুজিবুর রহমানও সেই মুহূর্তে একই আহ্বান জানান। যদিও সেই চুক্তিতে ‘ক্ষমা চাওয়া’ কথাটি ব্যবহার হয়নি।

একই বছর, অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের ২৯ জুন। শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘শেষ নবীর নামে, আমি তোমাদের কাছে তোবা করছি।’

সেই বক্তব্যে তিনি ১৯৭১ সালের দমন-পীড়নের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। ভুট্টো বলেন, পাকিস্তান যে দুঃখজনক অধ্যায় তৈরি করেছিল, তার জন্য তিনি অনুতপ্ত। তবে একই সঙ্গে তিনি দায় চাপান তৎকালীন সেনাশাসক আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের স্বৈরশাসনের ওপর।

seventy-one

তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান এখন থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। বরং দুই দেশ যেন পুনর্মিলনের পথে এগিয়ে যায়, সেই আশাবাদ জানান। তথ্যমতে—সেদিন ভুট্টোর কথায় নীরব হয়ে গিয়েছিল পুরো হলরুম। বাংলাদেশের অনেক নেতা-মন্ত্রীকে চোখের পানি মুছতে দেখা যায়।

এরপর ৭১ ইস্যুতে ২০০২ সালে আবারও দুঃখপ্রকাশ করে পাকিস্তান। সে বছরের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ সফরে আসেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ঢাকায় এক ভাষণে তিনি ১৯৭১ সালের ট্র্যাজেডির জন্য গভীর দুঃখপ্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে একাত্তর ইস্যু কি বাধা হতে পারে?

 

মোশাররফ বলেন, ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর যন্ত্রণায় পাকিস্তানের ভাই-বোনরাও সমানভাবে ব্যথিত। তাই অতীতের দুঃখ ভুলে দুই দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্ক গড়ার আহ্বান জানান তিনি। 

সেদিন তার ভাষ্যে উঠে আসে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা। তিনি বলেন, আমরা অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাব। তার মতে— বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনীতি ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো সম্ভব।

সে দিনের ভাষণে দুই দেশের জনগণের সম্পর্ককে ‘ভ্রাতৃত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘যেখানে অতীত প্রজন্ম কিছু সেতু ভেঙে দিয়েছে, সেখানে নতুন প্রজন্ম নতুন সেতু গড়বে।’ পারভেজ মেশাররফের সেই সফরকে পাকিস্তান বর্ণনা করেছিল ‘শান্তি ও পুনর্মিলনের প্রয়াস’ হিসেবে।

এরপর, ২০১০-১১ অর্থবছর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে প্রথমবারের মতো ১৯৭১ সালের জন্য দুঃখপ্রকাশ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সেই আলোচনায় কয়েকজন সংসদ সদস্য বলেন, পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে যা ঘটেছে, তার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

তাদের বক্তব্য ছিল, ১৯৭১ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের দায় পাকিস্তান এড়িয়ে যেতে পারে না। যদি ক্ষমা না চাওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থায়ী ও আন্তরিক সম্পর্ক গড়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। সে সময় প্রস্তাব তোলা হয়, পাকিস্তান পার্লামেন্ট যেন সরকারিভাবে অনুমোদিত ‘দুঃখপ্রকাশের প্রস্তাব’ পাস করে। যদিও তখন সেই প্রস্তাব আর ভোটে ওঠেনি। ফলে আনুষ্ঠানিক কোনো ক্ষমা বা পূর্ণাঙ্গ রেজুলিউশন গৃহীত হয়নি।

আরও পড়ুন

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে একাত্তর ইস্যু নেই

একাত্তরের ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও একাধিকবার মন্তব্য করেছেন। বিশেষ করে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গে তার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট ও বিবেচনাপ্রসূত। দেশটির এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে তাকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়, ‘১৯৭১ সালের সেনা অভিযানের জন্য পাকিস্তান সরকারের কি এখন বাংলাদেশিদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময় এসেছে?’

ইমরান খান বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সেনা অভিযানের সমর্থক ছিলেন। কারণ, সে সময় পাকিস্তানে কোনো স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ছিল না। পরে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি বাঙালি বন্ধুদের কাছ থেকে একাত্তরের নির্মম বাস্তবতা জানতে পারেন।

তার ভাষায়, সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন সবসময়ই ক্ষোভ তৈরি করে। আমাদের অবশ্যই সেই ভুলের জন্য দুঃখপ্রকাশ করা উচিত।

তিনি অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, একই ধরনের ভুল এখনো পাকিস্তানে, বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও উত্তরের এলাকায় ঘটছে, যা আর কখনো হওয়া উচিত নয়।

২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইমরান খানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, পাকিস্তান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে কিছুই শিখতে পারেনি। সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি ও অন্যান্য গণমাধ্যম

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর