দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম খাতের বাজার দ্রুত বাড়ছে। তবে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা ও বিনিয়োগ না থাকায় এখনো ৯০ শতাংশের বেশি সরঞ্জাম আমদানি করতে হচ্ছে। এ খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ১০ দফা দাবি জানিয়েছে চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিএএমডিএসআইএমই।
রোববার (১০ আগস্ট) দুপুরে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেডিকেল ডিভাইসেস অ্যান্ড সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স (বিএএমডিএসআইএমই) কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম খাতের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ দাবি জানানো হয়।
বিজ্ঞাপন
মতবিনিময় সভায় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির শিল্পে নজিরবিহীন প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল রোগের হার বাড়া এবং প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ—সব মিলিয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা বিশ্বজুড়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
তাঁদের ভাষ্য, ২০২৫ সালে এ খাতের বাজারমূল্য হবে আনুমানিক ৫০১ থেকে ৭০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৮০০ বিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বিএএমডিএসআইএমইর সভাপতি মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা সরঞ্জাম খাত বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ধারায় এগোচ্ছে। বর্তমানে এই বাজারের আকার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা প্রতিবছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। দেশের প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম প্রধান অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে এই শিল্পের বাজার ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারে। অর্থাৎ, শুধু দেশীয় চাহিদা মেটানো নয়, সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারেও উল্লেখযোগ্য অবস্থান নেওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, ডায়াগনস্টিক যন্ত্র, চিকিৎসা ইমেজিং মেশিন, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম, হাসপাতালের ব্যবহারযোগ্য নানা উপকরণ, সিরিঞ্জ, স্যালাইন সেট, সুরক্ষা পোশাক—এই সব সরঞ্জাম আধুনিক চিকিৎসার জন্য অত্যাবশ্যক। অথচ, দেশের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ চিকিৎসা সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়, এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দিলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা সরাসরি হুমকিতে পড়ে। অথচ চাইলে অনেক পণ্য দেশেই উৎপাদন সম্ভব। বর্তমানে দেশে উৎপাদনের হার মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ, যা উন্নত প্রযুক্তি, নীতিগত সহায়তা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
বক্তারা বলেন, দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্পের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে অপসো স্যালাইন এবং ১৯৯৯ সালে জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেসের মাধ্যমে। এরপর আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন, যেমন—সিই মার্কিং, আইএসও ১৩৪৮৫, আইএসও ৯০০১, জিএমপি মানদণ্ড ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাকযোগ্যতা অর্জন করে। বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি সিরিঞ্জ, স্যালাইন সেট, রক্ত পরিবহণ টিউব, পিপিইসহ বিভিন্ন পণ্য ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ৪০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
তবে খাতটির অগ্রগতির পথে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। নীতিগত সহায়তার অভাব, উৎপাদন উপযোগী কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, গবেষণা ও উদ্ভাবনে সীমিত বিনিয়োগ, খণ্ডিত বাজার কাঠামো, সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব এবং শুল্ক জালিয়াতির মতো সমস্যায় দেশীয় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বক্তারা মনে করেন, সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোয়, তাহলে এই খাত কেবল আমদানিনির্ভরতা কমাবে না, বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় উৎস হয়ে উঠতে পারে।
বিএএমডিএসআইএমই শিল্পের বিকাশে যে ১০ দাবি
- চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্পে কর অবকাশ (ট্যাক্স হলিডে) সুবিধা দেওয়া
- রপ্তানি প্রণোদনা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্তত ২০ শতাংশ করা এবং ১০ বছর বহাল রাখা
- তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পের সফল অভিজ্ঞতা এই খাতে প্রয়োগ
- প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনে বিশেষায়িত পাঠ্যক্রম চালু
- চিকিৎসা সরঞ্জাম ও শল্যচিকিৎসা যন্ত্র খাতকে পৃথক শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি ও নীতিগত সহায়তা
- ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অধীনে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো গড়ে তোলা
- আমদানিতে শুল্ক জালিয়াতি রোধে সঠিক এইচএস কোড প্রয়োগ
- সরকারি ক্রয়ে দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা এবং উৎপাদনযোগ্য পণ্যের আমদানি বন্ধ
- চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিকারকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা চালু
- দীর্ঘদিন ধরে নির্ধারিত খুচরা মূল্য অপরিবর্তিত থাকায় উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত—মূল্য সমন্বয় জরুরি
সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম খাত কেবল একটি শিল্প নয়, এটি মানুষের জীবন ও সুস্থতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই খাতের বিকাশে বিলম্ব মানে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত—দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানো, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করা। যথাযথ বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ও সহায়ক নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈশ্বিক চিকিৎসা সরঞ্জাম বাজারেও গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
সভায় আরও বক্তব্য দেন গেটওয়ের নির্বাহী পরিচালক (বিজনেস) সাঈদ হোসেন চৌধুরী, এএনসির ডা. মোহাম্মদ সেলিম, গেটওয়েলের আবু সুফিয়ান প্রমুখ।
এসএইচ/এআর

