রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

চীনা মেডিকেল এক্সপোতে উপচে পড়া ভিড়, চিকিৎসা নিতে আগ্রহী বাংলাদেশিরা

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ০৮:০৬ পিএম

শেয়ার করুন:

চীনা মেডিকেল এক্সপোতে উপচে পড়া ভিড়, চিকিৎসা নিতে আগ্রহী বাংলাদেশিরা
বনানীতে দিনব্যাপী চীনা-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা উন্নয়ন প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর বনানীতে দিনব্যাপী চীনা মেডিকেল ‘নি হাও! চীনা-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা উন্নয়ন প্রদর্শনী’ এক্সপো অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল ৯টায় শুরু হয়ে চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এদিন সকালে এক্সপোর উদ্বোধন করেন দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। এতে উপচে পড়া ভিড় ছিল চীনে চিকিৎসা নিতে ইচ্ছুক সাধারণ মানুষের। 

সরেজমিন এক্সপোতে গিয়ে দেখা যায়, চীনে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য পরামর্শ নিতে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন রোগীরা। এক্সপোতে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ। সকাল থেকে বুথগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। কেউ আক্রান্ত ক্যান্সারে, কেউবা ভুগছেন অর্থোপেডিক্স সংক্রান্ত রোগে। রোগীদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক দেখিয়েছেন, পাচ্ছেন না আশানুরুপ ফলাফল। অনেকেই হতাশ হয়ে বিদেশে চিকিৎসা করাতে চান এবং চীনে গিয়ে চিকিৎসা নিতে চান দেশের মানুষ।


বিজ্ঞাপন


chin-2

জানতে চাইলে এক্সপোতে আসা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা জাকির হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, কয়েক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি। দেশের অনেক জায়গায় চিকিৎসক দেখিয়েছি, কিন্তু ফলাফল পাচ্ছি না। এবার চাচ্ছি, বিদেশের চিকিৎসক দেখাতে। আশা করি, বিদেশে চিকিৎসা দেখালে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

ব্যবসায়ী শফিকুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, কয়েক বছর আগে আমার পোস্টেড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের এই রোগের চিকিৎসার উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ চিকিৎসক নেই। দেশে আস্থা না পেয়ে ভারতে চিকিৎসা নিয়েছি। সেখানে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা প্রদান করেন চিকিৎসকরা। এখন যেহেতু চীন-বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নতুন দ্বার উন্মোচন হচ্ছে, এজন্য আমি চীনে চিকিৎসা নিতে চাই।

আরও পড়ুন: শুক্রবার ‘নি হাও! চায়না-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা উন্নয়ন প্রদর্শনী’


বিজ্ঞাপন


 তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা ভালো এবং আন্তরিকতা আছে। বাংলাদেশের উন্নত টেকনোলজি আর দক্ষ জনবল নাই। এসব ঘাটতি পূরণ করতে পারলে দেশের স্বাস্থ্যখাত আগাবে।

এক্সপোতে আসা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন, দেশের মানুষ দেশেই যথাযথ চিকিৎসা নিতে পারে। আমি দীর্ঘ দিন ধরে হাঁটুর সমস্যায় ভুগছি, খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। বাংলাদেশে দুই জায়গায় চিকিৎসক দেখিয়েছি, এক জায়গায় এক কথা বলেন। এতে আমি বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছি এবং বাংলাদেশের চিকিৎসকদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী ফলাফল পাচ্ছি না। যার কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এবার চীনে গিয়ে চিকিৎসা নিবো।

chin-3

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার গাজী আবু বকর ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছি। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা খারাপ না, তবে উন্নত টেকনোলজি নেই। আমার যে সমস্যা, সেই সমস্যার টেকনোলজি বাংলাদেশে নাই, রয়েছে ভারত, সিঙ্গাপুরসহ উন্নত দেশগুলোতে। সরকার চাইলে বাংলাদেশেও উন্নত টেকনোলজি আনতে পারে, সরকারের স্বদিচ্ছার অভাবে বাংলাদেশে উন্নত টেকনোলজি আনা হচ্ছে না এবং দক্ষ লোকবল তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশে উন্নত টেকনোলজি আনা হলে মানুষ দেশেই চিকিৎসা গ্রহণ করবেন।

জানা গেছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড হেলথকেয়ার সেন্টার বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত এই এক্সপোতে সহ-আয়োজক হিসেবে যুক্ত ছিল চায়নিজ মেডিকেল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, চায়না-বাংলাদেশ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডক্টরস অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এবং আমরা নারী।

আয়োজকরা জানিয়েছেন, প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষকে আধুনিক চীনা চিকিৎসা ব্যভস্থা, হাসপাতাল সেবা এবং প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করা। এ উপলক্ষ্যে চীনের ১২টিরও বেশি শীর্ষ স্থানীয় হাসপাতালের প্রতিনিধি, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সরাসরি উপস্থিত থেকে স্বাস্থ্য পরামর্শ, স্ক্রিনিং এবং অন্যান্য সেবা প্রদান করেন। অংশগ্রহণকারীরা অন-সাইট ও অনলাইন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ, চিকিৎসার আমন্ত্রণপত্র, ভিসা সহায়তা, বিনামূল্যে অনুবাদ সেবা এবং বিমানবন্দর পিকআপসহ নানা সুবিধা সম্পর্কে তথ্য পান।

চীনের কিছু হাসপাতাল

বাংলাদেশের রোগীদের জন্য উন্মক্ত চীনের হাসপাাতালের মধ্যে রয়েছে চীনের বোও ইয়িলিং হাসপাতাল, ফোসুন হেলথ ও শেনজেন হেংশেং হাসপাতাল, ফোশান ফোসুন চাঞ্চেং হাসপাতাল, গুয়াংজু ফোসুন চাঞ্চেং হাসপাতাল ও গুয়াংজু শেংমেই হাসপাতাল। এছাড়া রয়েছে গুয়াংজু ফুদা ক্যান্সার হাসপাতাল, কুনমিং থংরেন হাসপাতাল, মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতাল (গুয়াংজু) এবং সিং মে হাসপাতাল (গুয়াংজু)।

সহজ হচ্ছে চীনে ভিসা

জানতে চাইলে মেডিকেল ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করা মেডিট্রিপ ৩৬০ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মোহাম্মদ শাহাদাত রশিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক দূর এগিয়েছে চীন। ক্যান্সার, অর্থোপেডিক্স ও অন্যান্যখাতে তাঁরা খুবই উন্নত করেছে। যার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে মানষ চীনে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশের রোগীদের জন্যও নতুন দুয়ার খুলেছে।

আরও পড়ুন: চীন-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা উন্নয়ন প্রদর্শনী উদ্বোধন

তিনি বলেন, আগে চীনের ভিসা পাওয়ার একটা জটিলতা ছিল, সেটা সহজ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে চীনা ভাষাগত সমস্যা ছিল, রোগীদের জন্য এই বিষয়টি সমাধান করা হচ্ছে। চীনে বাংলাদেশে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন, রোগীদেরকে তাঁরা সহযোগিতা করবেন। বাংলাদেশ থেকে চীনে যাওয়া রোগীদেরকে পূর্ণাঙ্গভাবে যেভাবে সাপোর্ট দেয়া যায়, সেভাবে দেয়া হবে।

বাংলাদেশীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত চীন

চীনে চিকিৎসা নিতে ইচ্ছুক রোগীদেরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত রয়েছে দেশটির হাসপাতালগুলো। সেইসঙ্গে অত্যন্ত যত্ন সহকারে সেবা দিবেন চিকিৎসকরা। জানতে চাইলে ফোশান ফোসুন চাঞ্চেং হাসপাতালের ইন্টারন্যাশনাল হেলথ কেয়ার ইউনিটের পেশেন্ট রিলেশন ম্যানেজার ইলশা ট্যান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশের রোগীরা আমাদের দেশে আসুক। তাদেরকে সেবা দিতে পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত রয়েছি। চীনের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। রোগীরা সেখানে সেবায় মুগ্ধ হবে।

তিনি বলেন, চীনের চিকিৎসকরা একেবারে প্রফেশনাল, তারা রোগীদেরকে সময় নিয়ে দেখেন। চীনে রয়েছে উন্নত টেকনোলজি এবং দক্ষ লোকবল। সঠিক ও সুনিপুণভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়।

chin-4

এ বিষয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, চীন আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি ও উচ্চমানের হাসপাতাল পরিষেবায় বিশ্বজুড়ে পরিচিত। আমরা বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে একটি টেকসই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই।

তিনি বলেন, বাংলাদেশি রোগীদের জন্য আমাদের দরজা উন্মুক্ত। আমরা চাই, বাংলাদেশিরা উন্নত চিকিৎসা পাক এবং সুস্থ হয়ে দেশে ফেরেন। বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীনে চিকিৎসার সুবিধা বাড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তাদের জন্য আমরা ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করেছি। পাশাপাশি চাইনিজ এয়ারলাইন্সও বিশেষ ছাড়ে টিকিট দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠাতে আগ্রহী

এদিকে চীনের অংশগ্রহণকারী হাসপাতালগুলোর প্রতিনিধিরা জানান, বাংলাদেশের বিগত বিভিন্ন সংকট পাশে ছিল চীন। তারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য আরও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠাতে আগ্রহী এবং একাধিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশি চিকিৎসকদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় সহযোগিতা করতে চান তারা।

চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করতে সহযোগী চীন

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করতে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে চীন। সেইসঙ্গে নানাভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতাও করছে। এবিষয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার আধুনিকায়নে চীন নানাভাবে সহায়তা করছে। চিকিৎসা সেবায় এআই ও রোবোটিক প্রযুক্তি ব্যবহারে চীনের সহায়তা চেয়েছি।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত যন্ত্রপাতি দেশেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাজ করছে বাংলাদেশ। যাতে দেশেই উৎপাদিত হয় এসব যন্ত্রপাতি। চীন থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়ে এসে পরামর্শ কর্মশালার আয়োজন করতে কাজ করছে বাংলাদেশ।

নুরজাহান বেগম বলেন, আমাদের যন্ত্রপাতি নাই। এমআরআই মেশিন নাই। সিটি স্ক্যান মেশিন নাই। কিডনি ডায়ালাইসিসের মেশিন নাই। এসব মেশিন বাইরে থেকে আনতে গেলে ৩-৬ মাস লেগে যায়। তাই আমরা চীনের সঙ্গে কোলাবোরেশান করে দেশেই এসব যন্ত্রপাতি বানানো যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা করেছি। এতে অল্প সময়ে কম দামেই আমরা এসব কিনতে পারবো। সেবাটাও নিশ্চিত করা যাবে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ইপিজেডে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এদিকে দিনে দিনে চীনের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সেইসঙ্গে বাংলাদেশিরা চিকিৎসা নিতে চান চীনে। বাংলাদেশের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে চীনও। এর আগে গত ১০ মে চীনে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪ জন রোগী সেবাগ্রহণ এবং চীনের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

এসএইচ/এআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর