রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইসির প্রস্তুতি

মো. মেহেদী হাসান হাসিব
প্রকাশিত: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইসির প্রস্তুতি
ফাইল ছবি।

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে কয়েকটি বিশেষ কমিটি গঠনসহ ভোট পর্যবেক্ষণে থাকবে ডিজিটাল সার্ভিল্যান্স। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম কেমন হবে, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার আগেই পর্যালোচনা সভার আয়োজন করতে যাচ্ছে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম নির্ধারণে তৈরি করা খসড়া প্রস্তাবনা থেকে এসব তথ্য জানা যায়।


বিজ্ঞাপন


ইসি সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর একটি নির্বাচনের সবেচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। এজন্য আমরা আগে থেকে এসব কাজ গুছিয়ে রাখছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যসব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে প্রস্তুতিমূলক নিরাপত্তা সভা হওয়ার পর এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিয়ে সংলাপে বসারও একটি পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

গত ২৬ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বড় কোনো বাধা হবে না। বর্তমান পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।

নির্বাচন ঘিরে তিন ধাপে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি


বিজ্ঞাপন


জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তিন ধাপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে নিরাপত্তা বাহিনী। তফসিল ঘোষণার আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়। এ পর্যায়ে কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের অধীন নয়।
তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে নির্বাচনি পরিবেশ। বহিরাগত অনুপ্রবেশ রোধ, প্রার্থীদের প্রচারণায় সমান সুযোগ নিশ্চিত এবং ভোটারদের নিরাপদ পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগে মাঠে থাকবে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। পাশাপাশি নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন দায়িত্বে। হয়রানি বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। ভোটের পরবর্তী ৯৬ ঘণ্টাও নিরাপত্তা বাহিনী সক্রিয় থাকবে সহিংসতা প্রতিরোধে। একই সঙ্গে দুই দিন পরিচালিত হবে সংক্ষিপ্ত বিচার কার্যক্রম।

ভোট মনিটরিংয়ে থাকবে ডিজিটাল সার্ভিল্যান্স

প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিজিটাল সার্ভিল্যান্স প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনের আইসিটি অধিশাখা কিংবা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সিসিটিভি ক্যামেরা, ফেস রিকগনিশন সফটওয়্যার, ড্রোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিং, মোবাইল ট্র্যাকিংসহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে। এতে নির্বাচনি পরিবেশে স্বচ্ছতা বাড়বে এবং সহিংসতা বা আচরণবিধি লঙ্ঘন প্রতিরোধ সহজ হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

akhter-

 সোমবার নির্বাচন ভবনে ব্রিফিংকালে ইসি সচিব আখতার নির্বাচন ঘিরে কমিশনের প্রস্তুতি তুলে ধরেন। ছবি: সংগৃহীত

তবে এর পাশাপাশি রয়েছে কিছু ঝুঁকিও। যেমন—নেটওয়ার্ক ত্রুটি, সাইবার নিরাপত্তার দুর্বলতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার ও প্রার্থীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা। এছাড়া গুজব, বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট এবং বিভ্রান্তিমূলক AI ভিডিও/ছবি প্রচারের মাধ্যমে ভোটের পরিবেশ ব্যাহত হতে পারে। এমনকি নির্বাচনি এলাকায় অনুমতি ছাড়া ড্রোন ব্যবহার করলে তা ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে বলেও সতর্ক করেছে সংশ্লিষ্ট মহল।

ভোট পর্যবেক্ষণের বিশেষ কমিটিতে থাকবে নিরপেক্ষ ব্যক্তি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত করা হবে ভিজিল্যান্স ও অবজারভেশন কমিটি। যেখানে রাখা হবে বিভিন্ন সরকারি বিভাগের প্রতিনিধির পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ের নিরপেক্ষ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় এ টিম গঠন করা হচ্ছে যেন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা বজায় এবং তা জনগণের কাছেও দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। একইভাবে উপজেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার নেতৃত্বে ভিজিল্যান্স টিম গঠন করা হবে।

নির্বাচনে তদারকি কমিটিতে থাকছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় গঠিত হবে নির্বাচন তদারকি কমিটি বা মনিটরিং টিম। রিটার্নিং অফিসারের নেতৃত্বে এ টিমে থাকবেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতিনিধিরা।

আরও পড়ুন: জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মুখ খুললেন ইসি সচিব

এ কমিটি নির্বাচনি আচরণবিধি, আইন ও বিধিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা তদারকি করবে। না হলে প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার দিকটি নিশ্চিত করবে।

pppp
একটি শাস্তিপূর্ণ ভোটের অপেক্ষায় দেশের মানুষ। ছবি: সংগৃহীত

নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ সেল গঠন

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় গঠন করা হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সেল। সেলের নেতৃত্বে থাকবেন রিটার্নিং অফিসার। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশ সুপার বা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি, সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোনীত কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার। এই সেল নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি প্রতিরোধে সমন্বিত কাজ করবে।

নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ে মনিটরিং সেল গঠন

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচন ভবন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রনে গঠন করা হবে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ে মনিটরিং সেল। সেলের নেতৃত্বে থাকবেন ইসির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার-ভিডিপি ও সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরাও থাকবে।

সেলের মূল কার্যক্রম শুরু হবে ভোটগ্রহণের আগের দিন সকাল ৮টা থেকে এবং চলবে ভোটের পরবর্তী দিনের পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত, মোট ৭২ ঘণ্টা। এই সময় বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত যাচাই-বাছাই করে নির্বাচন কমিশনকে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট পর পর অবহিত করতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ প্রতিবেদনও প্রেরণ করা হবে।

তাছাড়া, সেল সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য, পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত অটোমেটেড রিপোর্টগুলো ‘আইনশৃঙ্খলা মনিটরিং অ্যাপস’ এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলে তাৎক্ষণিক পাঠানো হবে, যা নির্বাচন পরিচালনায় আরও স্বচ্ছতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। নির্বাচনে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে এই মনিটরিং সেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা

জানা যায়, কমিশনে এ বিষয়ে আলোচনার পর সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হবে। সভায় প্রণীত নিরাপত্তা পরিকল্পনা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া হবে। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ১৬ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জন করে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন ছিল। এবার কেন্দ্রভিত্তিক নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে সংখ্যাটি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া তফসিল ঘোষণার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সভা আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনি এলাকাভিত্তিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ সভায় প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর বিভাগীয় পর্যায়েও প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিয়ে সমন্বয় সভা আয়োজনের সুপারিশ রাখা হয়েছে, যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়।

ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে সংসদীয় আসনের সীমানা, নতুন দলেন নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও কেনাকাটাসহ ভোটের সব কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলছে। ৬০ দিনের মতো সময় হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন কমিশন একদিকে নিজেদের প্রস্তুতি পুরোদমে সারছে এবং অপরদিকে সরকারের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছে।

এমএইচএইচ/এআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর