আয়নাঘর। বাইরে উৎসুক জনতার ভিড়। সঙ্গে উচ্ছ্বাস। কিন্তু খানিক বাদেই বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। দর্শন শেষে মুষড়ে যাওয়া মুখখানি দেখে বোঝা যাচ্ছে-হৃদয়ে বিঁধেছে বিষমাখা তীরের মতোই!
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে যেন হঠাৎই সময় থেমে গেছে। চারদিক থেকে ছুটে আসছে মানুষের ভিড়। কেউ চুপচাপ তাকিয়ে আছে, কেউ চোখ মুছছে। কেউ স্মৃতি আওড়াচ্ছে, কেউ আবার পুরোনো স্মৃতি নতুন করে ফ্রেমবন্দি করছে। আবার কিছু শিশু একপাশে খেলছে। চারদিক যেন এক অদ্ভুত বাস্তবতায় ভরে উঠেছে। একদিকে ইতিহাসের রক্তাক্ত কষ্ট, অন্যদিকে জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ।
বিজ্ঞাপন
ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন এক রিকশা, যার সামনের সিটে হেলে পড়ে আছে নিথর তরুণ। কাছেই ভ্যানে সাজানো লাশের স্তূপ। পেছন থেকে ট্যাংকের ওপর থেকে নিচে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে আরেকটি মৃতদেহ। আশেপাশে নীরব মানুষেরা তাকিয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। এদিকে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে আবু সাঈদ, চোখে তৃষ্ণা, ঠোঁটে অস্ফুট আহ্বান—‘বুক পেতেছি গুলি কর, বুকের ভেতর অনেক ঝড়’।
না, এই দৃশ্য কোনো বাস্তব সময়ের নয়। এটি একটি মঞ্চ প্রতিকৃতি, একটি অন্তরের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু যেভাবে তা উপস্থাপিত, আলো-ছায়ার ছন্দে, শব্দের অভিঘাতে, এক মুহূর্তের জন্য ভুল হয়ে যায়-এ কি প্রতিকৃতি, না কি চোখের সামনেই ঘটছে জুলাই বিপ্লবের রক্তভেজা সেই গল্পগুলো। যা দেখে শরীরের প্রতিটি লোম শিহরিত হয়, ঘৃণা আওড়িয়ে পড়ে স্বৈরাচারের মসনদে।

এই মঞ্চায়নের নাম ‘জুলাই জাগরণ’। আর এই নামেই ২০২৫ জেগে উঠছে সেই ২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাইয়ের স্মৃতিতে।
বিজ্ঞাপন
আয়নাঘর: নীরবতার মধ্যেই শোনা যায় গুমের কান্না
উৎসবের সবচেয়ে কাঁপানো উপস্থাপনাগুলোর একটি ছিল ‘আয়নাঘর’। এটি ছিল এক অন্ধকার কক্ষে বসে থাকা কিছু মানুষের নিস্তব্ধ উপস্থিতি। কেউ কিছু বলছে না, কেউ কাঁদছে না, কেউ পালাচ্ছে না। কিন্তু ওই নীরবতা এমনভাবে পরিবেশিত যে, দর্শকদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
এই মঞ্চটি শেখ হাসিনার শাসনামলের সেই ‘আয়নাঘর’ নামের প্রতীকী নির্যাতন কেন্দ্রের রূপক। এখানে বিরোধী রাজনীতির কর্মীদের ধরে এনে বছরের পর বছর গোপনে আটকে রাখা হতো।
দর্শনার্থীরা বলছেন, আমরা অনেক প্রতিবাদ দেখেছি, নাটক দেখেছি। কিন্তু এমন ভয়ংকর এক নিস্তব্ধতা আর দেখিনি। এটা যেন শুধু এক নির্যাতনের ঘর নয়, এ যেন আমার বিবেকের দরজা খুলে দিল।
শিশু তাফসির আলম বলে, ‘আমি ভাবছিলাম এগুলো নাটক বা সিনেমা। কিন্তু মা বললো-এসব সত্যি ঘটেছে। তখন আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।’ এমন ঘরে মানুষ বছরের পর বছর ক্যামনে থাকে প্রশ্ন অবুঝ শিশুটির।
আয়নাঘর পরিদর্শন শেষে স্কুল শিক্ষার্থী দুর্জয় বলে, ‘পুরো আয়োজন দেখে তো অনেক মজারই মনে হচ্ছিল। আয়নাঘরে ঢোকার আগেও হেসেছি। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি। কিন্তু সত্যি বলতে, যখন ভেতরে ঢুকলাম, তখন দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। দেখে ঠিক থাকতে পারিনি। দ্রুতই বের হতে বাধ্য হয়েছি। একটা প্রতীকী আয়নাঘর যদি এমন হয়, তাহলে বাস্তবতা কতটা হৃদয়বিদারক হবে, তা এখানে না আসলে হয়তো উপলব্ধি হতো না।’

রক্তে ভেজা সেই মাসের চিত্রায়ন
২০২৪ সালের জুলাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় এবং হৃদয়বিদারক অধ্যায়। ফ্যাসিবাদ, নিপীড়ন ও গুম-খুনের বিরুদ্ধে জনতার জাগরণ ছড়িয়ে পড়েছিল রাজপথ থেকে পাড়া-গাঁ পর্যন্ত। নিহত হয়েছিল অগণিত তরুণ। নিখোঁজ, বন্দি, নির্যাতিত মানুষের সংখ্যা ছিল হাজারে হাজার। ঠিক সেই ঘটনাগুলোই তুলে ধরা হয়েছে ‘জুলাই জাগরণ’-এ। যা শুরু হয়েছে শুক্রবার (১ আগস্ট) রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আয়োজক সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। তারা এ উৎসবকে বলছে, একটি স্মৃতি-জাগরণের অনুশীলন, একটি আত্মিক প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ।
এখানে ইতিহাস কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায় নেই, সে উঠেছে মঞ্চে, হেঁটেছে দর্শকের চোখের সামনে, ঢুকে পড়েছে হৃদয়ের গহীনে।
শিশুদের চোখে ইতিহাস: রঙ আর রক্তের এক অদ্ভুত সহাবস্থান
এই উৎসব শুধু বড়দের জন্য নয়, এখানে ছোটদের জন্যও ছিল রঙিন আয়োজন। বেলুন, বায়োস্কোপ, রাইড, মুখে আঁকা, ছোটদের গানে অংশগ্রহণ, খেলাধুলা-সবকিছু মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ মিলনমেলা।
তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই আনন্দঘন পরিবেশের মাঝেই শিশুরাও ছুঁয়ে দেখেছে ইতিহাসের ছায়া।

চার ও পাঁচ বছর বয়সী দুই শিশুকে নিয়ে এসেছিলেন মা আয়েশা খাতুন। মা বললেন, ছেলে-মেয়েটা গান গাইলো, হাসলো, খেললো। কিন্তু আমি ওকে নিয়ে যখন রিকশার পাশে দাঁড়ালাম, ও আমার হাত শক্ত করে ধরে বলল-‘মা জুলাই’। আমি ওর চোখে ভয় দেখেছি, আর বুঝেছি, শুধু আনন্দ নয়, ও ইতিহাসকে উপলব্ধি করেছে।’
এই ফেস্টিভ্যালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল একই মঞ্চে দেশের সকল জুলাই শহীদের প্রতীকী কবর। যে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে জীবন্ত ইতিহাসকে আরও একবার হৃদয়গ্রাহী করছে দর্শনার্থীরা। কেউ সন্তান, কেউ নিয়ে এসেছেন বন্ধুকে। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আত্ম উপলব্ধির ভাষায় বলছেন, বন্ধু দেশ স্বাধীন না হলে এখানে হয়তো আমার নামটাও আজ থাকতো।
সাংস্কৃতিক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের উত্তরণ
‘জুলাই জাগরণ’ শুধুই শিল্পের প্রদর্শনী নয়, এটি এক সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক উত্তরাধিকারকে সামনে আনার প্রয়াস।
আবৃত্তি, নাটক, গানের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে সেই ভয়ংকর জুলাইয়ের রাতগুলো, গুম হওয়া তরুণদের কান্না, প্রতিবাদীদের আহ্বান, শহীদের নিথর দেহ।

দর্শক কাইয়ু্ম আলী বলেন, যেহেতু এক রাজনৈতিক দলের সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজন, ভেবেছিলাম একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম এটি আত্মিক ধাক্কার মতো কাজ করেছে। আয়োজকরা শুধু কথা বলেনি, তারা দেখিয়েছে, অনুভব করিয়েছে। আরও একটি বিষয় অবাক হলাম, কোনো নেতার জন্য নেই স্লোগান, নেই শৃঙ্খলাহীন কোনো কাজ। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে এমন ফেস্টিভ্যাল এর আগে কখনো দেখিনি।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকারের জন্য যে লড়াই, তা শুধু অতীতের গল্প নয়। তা আজও প্রাসঙ্গিক, প্রয়োজনীয় এবং পুনর্জাগরণের দাবি রাখে। ‘জুলাই জাগরণ’ সেই পুনর্জাগরণেরই প্রতীক। এটি শুধুই ফেস্টিভ্যাল নয়, এটি একটি চেতনার বহিঃপ্রকাশ। একটি জীবন্ত স্মৃতির উৎসব, যেখানে শিল্প হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, গান হয়ে ওঠে আহ্বান, আর নিথর দৃশ্য হয়ে ওঠে জীবনের প্রতিচ্ছবি। শুধু নাট্যমঞ্চ নয়, এই আয়োজন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একটি আয়না, যেখানে জাতি নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে-দেখতে পারে, আমরা কেমন ছিলাম, কেমন হতে পারি।
এমআই/জেবি

