অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের যে খসড়া সনদ প্রকাশ করেছে তাতে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নেই বলে অভিযোগ করেছে জুলাই আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’ (আপ বাংলাদেশ)।
বুধবার (৩০ জুলাই) সংগঠনটির পল্টন্থ অস্থায়ী দলীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
তারা বলেন, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বরাতে আমরা একটি খসড়া সনদের খবর পাচ্ছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই খসড়া সনদটিতে বাংলাদেশের মানুষের লড়াইয়ের স্বীকৃতি এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নাই। আমরা এই খসড়া সনদ প্রত্যাখ্যান করছি।
এই সনদে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের ধারাবাহিক সংগ্রামের প্রতিফলন নাই। বিশেষ করে জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে শোষিত বাঙালি মুসলমান এবং নিম্নবর্গের হিন্দুদের সংগ্রামের স্মরণ এই সনদের পটভূমিত পুরোপুরিভাবে অনুপস্থিত। পাশাপাশি এর ধারাবাহিকতায় ’৪৭-এর দেশভাগের আন্দোলন এবং এর অস্তিত্বকে স্পর্শই করা হয় নাই প্রস্তাবিত খসড়া সনদের পটভূমিতে।’
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ আদায়ের ব্যাপারে আমাদের দৃঢ় ও অনড় রাজনৈতিক অবস্থান ঘোষণা করছি।
গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পার হয়ে গেলেও সরকার এখন পর্যন্ত ঘোষণাপত্র ও সনদ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আপ বাংলাদেশ গত ৩০ জুন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জুলাই জুড়েই ঘোষণাপত্র ও সনদসহ ৫ দফা দাবিতে দেশব্যাপী গণসংযোগ এবং সভা-সমাবেশ করেছে। আমরা বলেছিলাম, সরকার যদি ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ঘোষণাপত্র ও সনদ না দেয়, তবে ১ আগস্ট আপ বাংলাদেশ বিক্ষোভ মিছিল করবে। আমাদের সেই বিক্ষোভ এবার গণজমায়েতে রূপ নেবে ইনশাআল্লাহ।
বিজ্ঞাপন
আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে ঘোষণাপত্র ও সনদ না দিলে ১ আগস্ট ঢাকার শাহবাগে বিকাল ৩টায় আমরা গণজমায়েতের ঘোষণা দিচ্ছি এবং ঢাকার সকল নাগরিক এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগনকে শুক্রবার বিকাল ৩টায় শাহবাগে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। শহীদ ওয়াসিম যেভাবে চট্টগ্রামের মুক্তিকামী মানুষকে ‘চলে আসুন ষোলশহর’ বলে ডেকেছিলেন, আমরাও আপনাদেরকে শহীদ ওয়াসিমের মতো করেই বলছি- ১ আগস্ট ‘চলে আসুন শাহবাগে’৷ আমরা এবার ঘোষণাপত্র ও সনদ আদায় করেই ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
খসড়া সনদের সমালোচনা করে তারা বলেন, ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখ থাকলেও এর পটভূমিতে যেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে এই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয় নাই। কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীতে এক দফা দাবি ও তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে, যারা রাজপথে নেমে এসে অকাতরে জীবন দিয়েছিল, সেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লড়াই ও আত্মত্যাগ, মাদরাসা শিক্ষার্থী ভাইয়েরা, আমাদের রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ট্রাক ড্রাইভার, ছিন্নমূল মানুষ ও ঢাকার রাজপথে পথশিশুদের লড়াইয়ের স্বীকৃতি মিলেনি এই প্রস্তাবিত খসড়া কাঠামোর পটভূমিতে।
পাশাপাশি গত সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে শুধুমাত্র স্বৈরাচারি শাসনামল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ফ্যাসিবাদী শাসনামল হিসেবে একে মূল্যায়ন করা হয়নি। এই সাড়ে ১৫ বছরে সংঘটিত গণহত্যা এবং বিচারিক হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ নাই সেখানে। বিশেষ করে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে গণহত্যা, মোদিবিরোধী আন্দোলনের গণহত্যার উল্লেখ নাই প্রস্তাবিত খসড়া সনদের পটভূমিতে। আমরা এই সমস্ত লড়াই, সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিয়ে সনদের পটভূমিতে অন্তর্ভূক্তির জোর দাবি জানাই।
প্রস্তাবিত কাঠামোর ভাষা ও শব্দচয়ন থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, জুলাই সনদ কোনো ‘আইনি দলিল’ নয়, বরং এটি শুধুমাত্র কিছু ‘সুপারিশ’ ও ‘প্রতিশ্রুতির’ সংকলন হতে যাচ্ছে। জুলাই সনদের নামে এই ধরনের একটি রাজনৈতিক বিবৃতি মাত্র, যার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এর কার্যকর প্রয়োগের নিশ্চয়তা নেই, এমন কোনো ভোঁতা আপসকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।
জুলাই সনদ হতে হবে পূর্ণাঙ্গ, আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক এবং গণআকাঙ্ক্ষাভিত্তিক৷ প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে একে আইনি রূপ দিতে হবে, এটিকে সংবিধানের অংশ করতে হবে এবং আগামী নির্বাচন হতে হবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে।
পাশাপাশি আপ বাংলাদেশ অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় এই কথা জানিয়ে দিতে চায় যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি, বরং এটি হয়েছে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ, আপামর ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে; রাজনৈতিক দলগুলো এর অংশ ছিল মাত্র।
তাই জুলাই সনদে স্বাক্ষরের এখতিয়ার শুধুমাত্র নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না, বরং জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে গঠিত ও সংগঠিত সকল রাজনৈতিক, আধা-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অংশীজনের স্বাক্ষরের ভিত্তিতে এই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।
জুলাই সনদের সাথে সংস্কার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিছু সংস্কারকে আমরা অত্যন্ত মৌলিক মনে করি যেগুলোর ব্যাপারে এখনো কোন ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। এমন দুটি সংস্কার হলো উচ্চকক্ষে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হিসাবে আসন বন্টন এবং এনসিসি বা ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল।
সংবাদ সম্মেলনে আপ বাংলাদেশের আলী আহসান জুনায়েদ, সদস্যসচিব আরেফিন মোহাম্মদ হিযবুল্লাহ, প্রধান সংগঠক নাঈম আহমেদ, মুখপাত্র শাহরিন ইরা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এমআর/এএইচ

