রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বিয়ামে আগুনে দুজনের মৃত্যু নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৫:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

বিয়ামে আগুনে দুজনের মৃত্যু নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য

চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম) ফাউন্ডেশনের একটি অফিস কক্ষে ভোররাতে অগ্নিকাণ্ডে দুই ব্যক্তির ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই ঘটনার পর সেখানে এসির বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল বলে খবর প্রচারিত হয়। কিন্তু ঘটনাটি তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিট জানায়, এসি নয়, নথি পোড়ানো আগুনে তাদের মৃত্যু হয়েছিল।

সোমবার (২৮ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর কল্যাণপুরে অবস্থিত পিবিআই উত্তর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান। 


বিজ্ঞাপন


এই ঘটনায় তখন একজন অফিস সহায়ক ও একজন গাড়িচালকের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে আসে। ঘটনার পর প্রায় তিন মাস তদন্ত করে পিবিআই জানালো এসি বিস্ফোরণে নয়; বরং এটি একটি হত্যাকাণ্ড।

এই ঘটনায় গত ২৫ জুলাই দুইজনকে কুড়িগ্রাম ও ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী মো. আশরাফুল ইসলাম (৩৬)।

গ্রেফতারকৃতরা পিবিআইকে জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল না তাদের, পেট্রোল ঢেলে শুধুমাত্র নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার কারণেই এই প্রাণহানি ঘটে যায়। আগুন লাগিয়ে নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার কাজে চুক্তি হয় ১০/১২ লাখ টাকায়।

সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টা ২০ মিনিটের দিকে বিয়াম ভবনস্থ ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রচণ্ড শব্দসহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ৫০৪ নম্বর কক্ষে রক্ষিত সমিতির দলিলপত্রাদি, নামজারী সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি, ব্যাংক হিসাব, চেক বই, জমি ক্রয় সংক্রান্ত ৪টি চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্র কক্ষের এসি ইত্যাদিসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়।


বিজ্ঞাপন


ঘটনার সময় অফিস সহায়ক মো. আব্দুল মালেক ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন এবং সমিতির সেক্রেটারির গাড়িচালক মো. ফারুক গুরুতরভাবে আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য জাতীয় বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় গাড়িচালক মো. ফারুক মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. মশিউর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেন।

তিনি আরও বলেন, পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শেষে তাদেরকে ১০/১২ লাখ টাকা দেয়ার মৌখিক চুক্তি করে। পরিকল্পনা মোতাবেক একদিন জাহিদ আশরাফুলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের পঞ্চম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে। জাহিদের দেওয়া টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস ও ফুল শার্ট জামা কেনেন।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন আশরাফুল মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ডগ্লাভস পরে বিয়াম ভবনের পঞ্চম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়।ক্যামেরা বন্ধ করার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অফিস সহায়ক মালেক ও ড্রাইভার ফারুক চতুর্থ তলার ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে। তখন আশরাফুল দরজার পাশে সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল। ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে গাড়িচালক মালেক বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।

পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান আরও বলেন, আশরাফুল পঞ্চম তলা থেকে তৃতীয় তলা নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ঘটনাস্থলেই অফিস সহায়ক মালেক মারা যায়। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ড্রাইভার ফারুককে জাতীয় বার্ন ইউনিট হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ড্রাইভার ফারুক মৃত্যুবরণ করলে জাহিদ আশরাফুলকে ডেকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলে। জাহিদের কথামতো পরদিন সে রংপুর চলে যায়। এই কাজে আশরাফুলকে ১০/১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও জাহিদ এখন পর্যন্ত তাকে ৬/৭ লাখ টাকা দিয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আশরাফুল ইসলাম পিবিআইকে জানায়, বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত এবং এলাকার ভাই। জাহিদুল ইসলাম তাকে গত বছরের ৫ আগস্টের ২/৩ মাস আগে ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা ৫/৬ মাস রাখে। জাহিদুল ইসলামের সূত্র ধরে সে প্রায়ই বিয়ামে যাতায়াত করতো এবং ওই অফিসের কাজে কয়েকজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম আসামি আশরাফুল, অফিস সহায়ক আ. মালেক ও গাড়িচালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করে।

বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান বলেন, হাতিরঝিল থানা পুলিশ দুই মাস মামলাটি তদন্ত করেছে। থানা পুলিশের কাছে তদন্তাধীন অবস্থায় পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে গত ৬ মে পিবিআই মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে এবং এসআই মোহাম্মদ গোলাম মওলাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

পিবিআইয়ের বিশেষায়িত টিম মামলার ঘটনার তারিখ ও সময়ের সংগ্রহকৃত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণে জানতে পারেন ২৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, পায়ে স্যান্ডেল পরিহিত অবস্থায় ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন যুবক বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিঁড়ি দিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় চলে যায় এবং সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়।

পিবিআইয়ের বিশেষায়িত টিম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আসামির ছবি শনাক্ত করে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআইয়ের একাধিক আভিযানিক টিম মিলে আত্মগোপনে থাকা ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামি মো. আশরাফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলামকে রাজধানীর ভাটারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

এমআইকে/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর