রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

শিশু-কিশোর শহীদদের রক্তে লেখা প্রতিবাদের ইতিহাস

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০১:৩৬ পিএম

শেয়ার করুন:

শিশু-কিশোর শহীদদের রক্তে লেখা প্রতিবাদের ইতিহাস

ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে কুমিল্লার দেবীদ্বার। বাংলাদেশের দুই প্রান্তের দুই জীবন এক সুতোয় গাঁথা হয়ে আছে শুধু প্রতিবাদের ভাষায়। তারা দু’জনই শিশু-কিশোর, স্বপ্নের বয়সেই শহীদ হয়েছেন। একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে, আরেকজন বাবাকে খুঁজতে গিয়ে পড়েছেন পুলিশের গুলির মুখে। ১৮ বছরের মেহেদী হাসান ও ১০ বছরের হোসাইন মিয়া-এই দুই নাম আজ শুধুই চোখ ভেজায় না, বিবেকও নাড়া দেয়।

প্রতিবাদের ডাকে জীবন উৎসর্গ মেহেদীর


বিজ্ঞাপন


মেহেদী হাসান ছিলেন রাজধানীর কাজলা এলাকার এক গাড়ি ওয়ার্কশপকর্মী। কেবল ১৮ বছর বয়স, কিন্তু তার স্বপ্নের পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন ঢাকার রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে, তখন পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে মেহেদী বেরিয়ে পড়েছিলেন ‘ছাত্র ভাইদের’ পাশে দাঁড়াতে।

তার মা পারভীন আক্তার সেই দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে এখনও কেঁদে ফেলেন। মেহেদী বলেছিলেন, ‘১৯ জুলাই বিকেলে ঘুম ভেঙে বলল, ছাত্র ভাইরা রাস্তায় মরছে, আমি কি এখনও শিশু?’

বাবা মেহের আলী তাকে আটকাতে বাসার দরজায় তালা দিয়েছেন। কিন্তু সংকল্পে অনড় মেহেদী জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি আন্দোলনে যাবই... প্রয়োজনে শহীদ হব।’

বাসা ছাড়ার সময় গোসল সেরে খেয়েছিলেন, মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ, যেন অজানা এক বিদায়ের ভাষা বলছিলেন চোখে। মাত্র ১০-১৫ মিনিট পরেই কয়েকজন শিশু খবর দেয়, মেহেদী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শুরু হয় মরিয়া খোঁজ। শনিরআখড়ার একাধিক হাসপাতাল ঘুরে, অবশেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মর্গে পাওয়া যায় তার নিথর দেহ।


বিজ্ঞাপন


শোকসন্তপ্ত মা বলেন, লাশ দেখতেও দিচ্ছিল না। থানায় পাঠিয়ে পুলিশ গালাগাল করল। গুলির হুমকিও দিল। ২১ জুলাই রাতে ময়নাতদন্ত শেষে তাকে দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে।
মেহেদীর পেটে তিনটি গুলির চিহ্ন ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেদিন পুলিশ ও শাসকদলের সমর্থকেরা নির্বিচারে গুলি চালায়।

মেহেদী ছিল চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। তার বাবা ময়লা পরিষ্কার করতেন, পরে একটি অটোরিকশা কিনে চালাতে শুরু করেন। পরিবারের আর্থিক সঙ্কটে মেহেদী নিজেও আয় করতেন। এখন তার ছোট ভাই রমজান দরজার কারখানায় কাজ করে সংসার টানছে।

পরিবার পেয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পাঁচ লাখ এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান। বাবার ভাষায়, ছেলের মৃত্যুতে আমরা ভেঙে পড়েছি, খুনিদের শাস্তি চাই, মৃত্যুদণ্ড চাই।

বাবাকে খুঁজতে গিয়ে শহীদ হলো ১০ বছরের হোসাইন

নারায়ণগঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জে ঘটে যায় আরেক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আচার বিক্রেতা মানিক মিয়ার ১০ বছর বয়সী ছেলে হোসাইন মিয়া বাবাকে খুঁজতে গিয়ে প্রাণ হারায়।

হোসাইন তার বাবার সঙ্গেই বাসে পপকর্ন ও পানি বিক্রি করত। ২০ জুলাই বিকাল ৩টায় মানিক মিয়া আন্দোলনে গেলে, সন্ধ্যায় তাকে খুঁজতে রওনা দেয় হোসাইন। একটু পরেই খবর আসে, শিশুটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

তার মা মালেকা বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে অনেক খোঁজার পর মর্গে দেখি আমার ছেলের লাশ পড়ে আছে। চারপাশে শুধু রক্ত, লাশ। স্বামী সেখানেই জ্ঞান হারাল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে পরিচয় নিয়ে সন্দেহ করে, লাশ বুঝিয়ে দিতে চায় না। রাতভর নানা হয়রানির পর, পরদিন রাত ১২টায় কাগজপত্র জমা দিয়ে মরদেহ বুঝে পায় পরিবার।

অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে মধ্যরাতে কুমিল্লার বেতরা গ্রামে এনে দাফন করা হয় হোসাইনকে। স্থানীয় মসজিদে জানাজায় অংশ নেয় শত শত মানুষ। কিন্তু প্রশাসনের কেউ উপস্থিত হয় নি।

হোসাইনের মা বলেন, ‘আমার ছেলেকে আমি নিজের হাতে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেছি। ওর কোনো দোষ ছিল না। ও তো কেবল বাবাকে খুঁজতে বের হয়েছিল।’

হোসাইনকে হারিয়ে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, তিন মাস কোনো কাজ করতে পারেননি। এখন আবার জীবিকার তাগিদে বাসে আচার বিক্রি শুরু করেছেন।

তার পরিবারও পেয়েছে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পাঁচ লাখ, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর পক্ষ থেকে দুই লাখ ও জামায়াতের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা। 

এই দুই কিশোরের জীবন ও মৃত্যু যেন প্রতিচ্ছবি এক অমানবিক সময়ের। যেখানে রাষ্ট্রের গুলিতে কেবল বড়রা নয়, শিশুরাও প্রাণ হারায়। জনগণের হৃদয়ে তাদের নাম রয়ে গেছে অমলিন। তাদের আত্মত্যাগ হয়তো একদিন আমাদের সকলের বিবেককে জাগিয়ে তুলবে। হয়তো একদিন তাদের গল্পই আমাদের মুক্তির পথ দেখাবে।

এমআই/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর