খুলনার রূপসা কিংবা নরসিংদীর রায়পুরা— দুই মায়ের বুকেই আজ এক অপূরণীয় শূন্যতা। একদিকে শহীদ ইয়াসিন শেখের মা মনজিলা বেগম, অন্যদিকে রাহাত হোসেন শরীফের মা স্বপ্না আক্তার। দুজনেই হারিয়েছেন তাদের আশার প্রদীপ, ভবিষ্যতের একমাত্র আলো। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো এই দুই কিশোরের গল্প যেন মুক্তির সংগ্রামে বাংলার হাজারো গৃহের রক্তাক্ত দিনপঞ্জির এক ক্ষতচিহ্ন।
ইয়াসিন: এক বুক দায়িত্ব, এক ঝলক বিদায়ের হাহাকার
বিজ্ঞাপন
ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার একটি এলপিজি গ্যাসের দোকানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করতেন ১৭ বছরের ইয়াসিন শেখ। বাবা মারা গেছেন যখন তার বয়স মাত্র দুই বছর। সংসারের হাল ধরতে খুব কম বয়সেই পাঁজর ভাঙা পরিশ্রমে নেমে পড়েন ইয়াসিন। কাঁধে ছিল মা মনজিলা বেগম আর দুই ছোট বোনের দায়িত্ব। গ্যাস সিলিন্ডার টেনে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলা এই কিশোরটির বুকে পুলিশ গুলি চালিয়ে কেড়ে নিয়েছে তার জীবন।
২১ জুলাই ২০২৪, ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন ইয়াসিন। তিনটি বুলেট বিঁধে যায় তার কিশোর বুকের গভীরে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঁচদিন যুদ্ধ করে ২৫ জুলাই নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ।
মনজিলা বেগম বলেন, একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে। বলে, আমার ছেলেকে গুলি করা হয়েছে। আমি দৌড়ে যাই। দেখি, রাস্তায় পড়ে আছে আমার বুকের মানিকটা।
ঘটনাস্থল থেকে প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করা টাকায় ইয়াসিনকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। কিন্তু জীবন ফিরে আসেনি। পুলিশের কাছে কোনো মামলা করেননি মনজিলা। তার কণ্ঠে নিস্তব্ধ হাহাকার- ‘আমার ছেলে কি ফিরে আসবে? গরিব মানুষ আমরা। কোনো দল করত না সে। শুধু ছাত্রদের ন্যায্য দাবি সমর্থন করেছিল।’
বিজ্ঞাপন
২৬ জুলাই খুলনার রূপসায় পারিবারিক কবরস্থানে স্থানীয়দের সহায়তায় দাফন করা হয় ইয়াসিনকে। গ্রামের মানুষজন মিলে অটোপসি ও দাফনের খরচ জুগিয়েছেন। সামান্য কিছু টাকা, অনেকটা ভালোবাসার ঋণ।
ইয়াসিনের বড় বোন নূরজাহান বলেন, ডাক্তাররা দুটি গুলি বের করলেও, একটা শরীরেই থেকে গিয়েছিল। সেটাই ভাইয়ের জীবন কেড়ে নেয়।
শুধু যে ভাইকে হারিয়েছেন তা নয়, তিন বোনের মাথার ছাদও ভেঙে পড়েছে। ইয়াসিন ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
রাহাত: বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন, গুলিতেই ভেঙে গেল সব
১৪ জুলাই ২০২৪, ঢাকার উত্তরা আজমপুরের নবাব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছিল রাহাত হোসেন শরীফ। এসএসসি পাশ করে সদ্য এইচএসসির পাঠ শুরু করেছিল। স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে পাড়ি দেওয়ার। ইউটিউবে দেখে নিজে নিজে জার্মান ভাষা শিখতো, পরিকল্পনা করতো জীবনের নতুন অধ্যায়। কিন্তু কে জানতো, ১৮ জুলাই বিকেলই হবে তার জীবনের শেষ সূর্যাস্ত?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে উত্তরা হাউজবিল্ডিং এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় রাহাত। সন্ধ্যা ৭টায় হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
রাহাতের মা স্বপ্না আক্তার বলেন, আমার ছেলে কখনও উচ্চবাচ্য করত না। রাজনীতি তো দূরের কথা, সে নামাজ পড়ে, পড়ালেখা করত। গুলিটা শুধু রাহাতকে না, আমাদের ভবিষ্যতকে হত্যা করেছে।
তিনি আরও বলেন, আমি এখনও ওর ছবি বুকে চেপে ধরে ঘুমাই। কাঁদতে কাঁদতে কখনও মূর্ছা যাই। একটাই ছেলে ছিল আমার। বন্দুকের গুলি আমাদের পরিবারের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।
রাহাতের বাবা সেলিম ফারাজী সৌদি আরবে কর্মরত। ছেলের মৃত্যুর পরেও দেশে ফিরতে পারেননি কঠোর ছুটিনীতির কারণে। সন্তান হারিয়ে স্বপ্না এখন একা। ঢাকার বাসা ছেড়ে ফিরে গেছেন গ্রামে, যেন তিনি শোকের গহ্বরে আত্মগোপন করেছেন।
‘অপরাধটা কী ছিল আমার সন্তানের?’ এই প্রশ্নে থমকে যায় কলম, থেমে যায় শব্দ। মনজিলা বেগম কিংবা স্বপ্না আক্তারের কণ্ঠে শুধু একটাই কথা- ‘আমার ছেলে কী অপরাধ করেছিল?’
এই দুজন তো কেবল প্রতীক। ২০২৫ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুলিতে শহীদ হয়েছেন শত শত তরুণ। বুক চিরে ঝরেছে রক্ত, পেছনে পড়ে রয়েছে কাঁদতে থাকা মায়েরা, হাহাকার করা বোনেরা।
গুলির ক্ষত শুকায় না
যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ছিল রাজধানীর অলিগলি। এই যুদ্ধে অস্ত্রধারী ছিল রাষ্ট্র, আর বিদ্রোহী ছিল সাধারণ ছাত্র-জনতা। ইয়াসিন, রাহাত কিংবা আবু সাঈদেরা কোনো রাজনৈতিক নেতার ছায়ায় বড় হয়নি, হয়নি কারও মদদপুষ্ট। তারা চেয়েছিল পরিবর্তন, চেয়েছিল ন্যায্যতা। তার বিনিময়ে পেয়েছে গুলি, রক্ত আর একটি শূন্য মা’র বুক।
এমআই/এফএ

