রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

স্ত্রীকে ঘুমে রেখে মিছিলে গিয়ে শহীদ হন গার্মেন্টসকর্মী জুয়েল

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৫:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

Juel
জুলাই বিপ্লবে শহীদ মো. জুয়েল রানা।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শালমারা ইউনিয়নের শাখাহাতি (বালুয়া) গ্রামের মো. জুয়েল রানা। জন্ম ১৯৯৭ সালের ৯ জুলাই এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনা শেষ না করে অল্প বয়সেই কাজে নেমে পড়েন। বাবার নাম মো. মোনতাজ উদ্দিন ব্যাপারী, মা মোছা. জমেলা খাতুন।

শহীদ জুয়েল রানা একই উপজেলার বারপাইকা গ্রামের মো. শাহজাহান আলী ও মোরশেদা বেগমের মেয়ে দুলালি আক্তারকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন। দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে তার। শহীদ জুয়েলের বড় মেয়ে জান্তা আক্তার জুঁই (৯) গাজীপুরের একটি হেফজ মাদরাসায় আবাসিক থাকে। ছোট মেয়ে জিম আক্তার জিনাত (৬)। সে তার নানাবাড়িতে নানির কাছে থাকে। বাবা শহীদ হওয়ায় মেয়ে দুটি এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।


বিজ্ঞাপন


শহীদ জুয়েল গাজীপুরের ইন্টারস্টোপ গার্মেন্টসে সুইং অপারেটর পদে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী দুলালি আক্তারও গাজীপুরের ইকো টেক্স গার্মেন্টসে কাজ করতেন। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে জুয়েল গাজীপুরের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।

৫ আগস্ট দুপুরে স্ত্রীকে ঘুমের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয় মিছিলে যান গার্মেন্টসকর্মী মো. জুয়েল রানা। গাজীপুর আনসার একাডেমির সামনে বিজয় মিছিলে অংশ নেন তিনি। সেখানে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়ে বাড়ি ফিরেন ২৭ বছরের এ টগবগে যুবক।

শহীদ জুয়েল রানার স্ত্রী দুলালি আক্তার বলেন, ‘৫ আগস্ট আমরা বেলা ১১টার দিকে একসঙ্গে নাস্তা করি। তখন আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য তার সঙ্গে কথা হয়। তখন সে বলে, আমার মেয়েরা যখন বড় হবে তখন বলবে, দেশে যখন আন্দোলন হয়েছিল তখন তোমরা কী করছিলা। আমি রক্ত দিছি আরও রক্ত দিব, একবার আমার রক্ত ঝরছে তো কী হয়েছে? এবার আমি শুধু রক্ত নয়, প্রয়োজনে জীবন দেব।’

দুলালি বলেন, ‘খাওয়া শেষে আমি ওর মাথায় মলম লাগিয়ে দিই। এরপর একসঙ্গে ঘুমাতে যাই। কিন্তু দুপুর ১২টার পর আমাকে ঘুমের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ও মিছিলে যায়। বিকেল ৩ টার দিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর আসে।’


বিজ্ঞাপন


‘পরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান, জুয়েল মারা গেছেন। এরপর বিকেল ৫টায় হাসপাতালে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় পাই।’

দুলালি আক্তার বলেন, ১২ বছর ধরে সুখে সংসার করছিলাম। সে আমার সবকিছু জুড়ে ছিল। সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। বিদেশ যাওয়ার পর শুধু আমার কারণে আবার দেশে চলে আসে। সবসময় বাবা-মা, শ্বশুড়-শাশুড়ি সবার খোঁজখবর রাখত। নিয়মিত টাকাপয়সা দিত।’

‘প্রতি বৃহস্পতিবার সে মাংস কিনত। সেই মাংস নিজে রান্না করতো। ও খিচুড়ি খুব পছন্দ করতো। রান্না করতে ভালোবাসত। বেশিরভাগ সময় সে-ই রান্না করত। আমরা ছুটি কম পেতাম। তেমন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হতো না। কিন্তু সে আমাকে প্রায়ই বাজার করতে বাজারে নিয়ে যেত।’

শহীদ জুয়েলের স্ত্রী বলেন, আমাদের সংসারে সুখের কোনো অভাব ছিল না। স্বামীকে হারিয়ে আমি এখন একা হয়ে গেছি। মেয়েরা আমাকে ওদের বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। ছোট মেয়েটা ওর নানির কাছে থাকলেও ওর বাবার জন্য কান্না করে। আমার তো পড়াশোনা নাই। তাই এখনো গার্মেন্টসেই চাকরি করতে হচ্ছে। সরকার যদি আমাকে একটি স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।’

শহীদ জুয়েলের মা মোছা. জমেলা খাতুন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন, ‘সকলের প্রিয়পাত্র আছিল হামার জুয়েল। হামার বাবার বুদ্ধি আছিল সেই। কিন্তু নম্র-ভদ্র ছিল। আমাদের দেখাশোনা করত। সেই যে ছয় ক্লাস পাস দিয়ে কামাইয়ের জন্য বের হইল, আর ফিরিল লাশ হয়ে।’

শহীদ জুয়েলের বড় জেঠা মোফাজ্জল হোসেন জানান, আমরা একই এলাকায় থাকতাম। ও নিয়মিত মিছিলে যেত। ৪ তারিখ বিকালে চন্দ্রায় মিছিলে গিয়ে মাথা ফেটে বাসায় আসে। সেদিন তার মাথায় ছয়টা সেলাই ছিল। পরদিন ৫ তারিখ শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার খবর পেয়ে হই-হুল্লোড় শুনে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে আবার মিছিলে যায়। আনসার একাডেমির ২নং গেটের সামনে জুয়েল মিছিলে অংশ নেয়। সেখানেই সে তলপেটে গুলি খায়। ভীড়ের মধ্যে কোনো হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছিল না। পরে কোনাবাড়ি-সফিপুর হয়ে তাকে তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার বারবার রক্ত জোগাড় করতে বলেন। আমরা রক্তের জন্য সবখানে খোঁজ করতে থাকি। কিন্তু রক্ত দেওয়ার আগেই ডাক্তার জানায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হামার জুয়েল মারা গেছে।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

শহীদ হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বেলা ১১টায় জানাজা শেষে শহীদ জুয়েল রানাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।

জুয়েলরা ছিলেন তিন ভাইবোন। শহীদ জুয়েল ছিলেন সকলের ছোট। বড় বোন মনজিল বেগম (৩০)। বিয়ে হয়েছে পাশের উপজেলা পলাশবাড়ীতে। মেজ ভাই মো. জসিম (২৯)। জুয়েলের মতো তিনিও গার্মেন্টসে চাকরি করেন। তার এক ছেলে লিমন (১২) ও এক মেয়ে জান্নাতি (১)।

ভাগ্য ফেরাতে কর্মের জন্য লিবিয়াতেও গিয়েছিলেন জুয়েল। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি। মারা যাওয়ার বছর খানেক আাগে ২০২৪ সালে লিবিয়া থেকে দেশে ফেরেন তিনি। ধারদেনা করে তাকে বাড়ি নিয়ে আসে তার পরিবার। বাড়ি আসার পর কিছুদিন গ্রামেই বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাতেন। শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত গাজীপুরের ইন্টারস্টোপ গার্মেন্টসে চাকরি করতেন শহীদ জুয়েল।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে শহীদ জুয়েলের স্ত্রীকে চার লাখ টাকা আর তার মাকে দেওয়া হয় ১ লাখ টাকা। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে ও মাকে ১ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি থেকে দেওয়া হয় ১ লাখ টাকা। এছাড়া জেলা পরিষদ থেকে শহীদের মাকে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

এসএইচ/এএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর