র্যাব শব্দনিরোধক বিশেষ ঘর তৈরি করেছিল গুম করা ভুক্তভোগীদের নির্যাতনের জন্য; যাতে ভুক্তভোগীদের কান্নার শব্দ বাইরে থেকে না শোনা যায়। ভুক্তভোগীদের ১০ ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হলে ওষুধ ও মলম দেওয়া হতো। এরপর শরীরের দাগ মুছলে তাদের জনসমক্ষে আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আজ মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেলে গুম সংক্রান্ত কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুম ও নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক দিক উন্মোচন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যে গুমের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তার পদ্ধতিগত চর্চা উন্মোচনের চেষ্টা করে কমিশন। গুম করে মানুষকে গোপন বন্দিশালায় মাস ও বছরের পর বছর রাখা হতো। এসব ব্যক্তিদের নির্যাতনের জন্য আলাদা ঘর তৈরি করা হয়েছিল। এসব ঘরগুলো বিশেষ কায়দায় শব্দনিরোধক করে তৈরি করা হতো। নির্যাতনের জন্য সেখানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার চেয়ার, ঘূর্ণয়মান চেয়ার, হাত–পা বাধার বিশেষ রশি, নখ তুলে ফেলাসহ শারীরিক নির্যাতন করতে বিভিন্ন যন্ত্র রাখা হতো। এসব ঘর র্যাব ও ডিজিএফআই ব্যবহার করতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের নির্যাতনের জন্য র্যাব ২–এর সিপিসি ৩–এ বৈদ্যুতিক ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে মানুষকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য পুলি–সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ঘর তৈরি করেছিল তারা।
গুম সংক্রান্ত কমিশন নির্যাতনের গুম হওয়া মানুষের ওপর চালানো নির্যাতনের দশটি দিক তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে। সেগুলো হলো—
সর্বব্যাপী অস্বস্তি সৃষ্টি করে রাখা হতো। এসব ব্যক্তিদের প্রহরীদের অর্ধেক খাবার দেওয়া হতো। নিজের ভাগ্যে কী ঘটবে সে কিছুই জানতো না। দীর্ঘ সময় মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতেন তারা।
বিজ্ঞাপন
ছোট্ট বন্দিশালায় যেখানে ঘুমাতো, সেখানেই টয়লেটের ব্যবস্থা। টয়লেটে বসলেও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করা হতো। বন্দিদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও অস্বস্তিকর ও ভীতিকর ছিল।
নারীদের জন্য গোপন বন্দিশালায় ছিল আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি। নারীদের গুম করে অনেকটা ক্রুসিফাইডের মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে রাখা হতো। এভাবে শরীরে ওড়নাও রাখতে দিতো না তারা। নারীদের পিরিয়ডের সময় তাদের প্যাড দেওয়া হতো না। উল্টো পুরুষ প্রহরীরা এটা নিয়ে হাসাহাসি করতো। ২০১৮ সালে ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে গুম করে তাকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছিল। ওই নারীর বর্ণনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
অসংখ্য গুম হওয়া মানুষের নির্মম প্রহারের অভিজ্ঞতা আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপন বন্দিশালা থেকে ব্যক্তিদের নির্যাতনের জন্য শব্দনিরোধক কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে কখনো চোখে গামছা বেধে, কখনো যমটুপি পরিয়ে হাত ওপরে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হতো।
২০২৩ সালে ডিএমপির সিটিটিসি ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে গুম করে ১৪ দিন গোপন বন্দিশালায় রেখেছিল। ওই ভুক্তোভোগী বলেন, ‘মারধরের সময় একাধিক লোক থাকতো। দুই-তিনজন মিলে পেটাতো। মারতে মারতে বলতো, তোর মাংস হাড্ডি আলাদা করে ফেলব।’
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের শরীরে একাধিক স্থায়ী আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে কমিশন। ২০১৭ সালে ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করে গুম করে র্যাব ১১ এর সদস্যরা। তাকে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে পা ওপরের দিকে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। তার নাভীর দুপাশে নির্যাতনের দাগ এখনও রয়েছে।
ডিএমপির সিটিটিসি নির্যাতনের জন্য চারটি শিফট ভাগ করে নিতেন কর্মকর্তারা। ২০২২ সালে সিটিটিসি ৪৬ বছরের এক ব্যক্তিকে গুম করে ২৫৩ দিন আটকে রেখেছিল। তাকে টানা ২৪ ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়। এজন্য চারটি শিফটে সিটিটিসির কর্মকর্তারা ভাগ হয়ে নিয়েছিলেন। তার জবানবন্দিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

হাত ছাদের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন, উল্টো করে বেঁধে নির্যাতন করতো র্যাব সদস্যরা। নির্যাতনের একটি কমন বিষয় ছিল নখ তুলে ফেলা। র্যাব সদস্যরা এই কাজটি প্রায়ই করতেন। এছাড়াও নখের ভেতরে সুইচ ঢুকিয়ে দিতো, বাঁশ দিয়ে নির্যাতন করত, বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, ওয়াটারবেডিং অর্থাৎ মুখের ওপর গামছা দিয়ে ওপর থেকে পানি ছাড়া হতো। এসময় তিন-চারজন টর্চার সেলের মেঝেতে হাত-পা দিয়ে চেপে ধরতো। ভুক্তোভোগীদের যৌন হয়রানি করা হতো। কেউ কেউ লজ্জায় কমিশনকে এই ঘটনা বলতে চায়নি, তারপরও কয়েকজন বন্দি এই বিষয়ে মুখ খুলেছিল কমিশনের কাছে। বন্দিদের প্রসাবের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম করে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখায় অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেকের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। একজন তরুণকে ২০১৯ সালে গুম করে র্যাব-৩ ও গোয়েন্দা শাখা। তাকে ২০ মাস ১৩ দিন গুম করে রাখা হয়। র্যাবের নির্যাতনে তিনি এখন মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। একাকী হাসছেন, কথা বলছেন এবং কাঁদছেন।
গুম সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, গুমের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ র্যাবের বিরুদ্ধে। তারা গুম করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গোপনে নির্যাতন করতো। এজন্য তাদের অনেক আয়োজন ছিল। নির্যাতনের পর আবার মেডিসিন দেওয়া হতো। যখন সুস্থ হতো; তখন একটি মামলা দিয়ে জনসমক্ষে আনা হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৩৪৫ জন।
এফএ