ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘মিডওয়াটার ট্রলার প্রতিস্থাপন’ অনুমোদনের ঘটনায় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মাত্র এক মাসেই ১৩টি ট্রলার, লং লাইনার ও সাপোর্ট ভেসেলের অনুমোদন দেওয়া হয়, যেখানে সরকারি নীতিমালা মানা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, অনুমোদন প্রক্রিয়ায় নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ট্রলারের কোনো নির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন জমা দেওয়া হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে অসম্পূর্ণ ও সাদামাটা কাগজপত্র। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ট্রলার আনার অভিযোগও পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দেওয়া অভিযোগপত্রেও এসব অনিয়মের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব তদন্তেও নানা অসঙ্গতির প্রমাণ মিলেছে।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, এই অনিয়মের পেছনে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করেছে। তথ্য বলছে, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের এপিএস হিসেবে দায়িত্বে থাকা আবু নঈম মো. আব্দুস সবুর এসব অবৈধ অনুমোদনের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের পিএস হিসেবে দায়িত্বে আছেন।
বিজ্ঞাপন
এছাড়াও যাদের নাম ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন— মৎস্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হল, ব্লু-ইকোনমি জোনের সিনিয়র সহকারী পরিচালক ড. মুহাম্মদ তানভীর হোসেন চৌধুরী, মৎস্য অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঊর্ধ্বতন সহকারী পরিচালক শওকত কবির চৌধুরী এবং পরিসংখ্যান কর্মকর্তা জহিরুল হক।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য-৪ শাখা থেকে একটি আদেশ জারি করা হয়। উপ-সচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার স্বাক্ষরিত ওই আদেশে সি-রিসোর্সেস লিমিটেডের ৬টি মিডওয়াটার ট্রলার আধুনিক ট্রলারে প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এই অনুমোদনে গ্রস টনেজের (জিটি) কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ট্রলারের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতায় ১০ শতাংশ কমবেশির অনুমতি দেওয়া হয়।
নেভাল আর্কিটেক্টদের মতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এত বড় সীমাবদ্ধতা লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই।
বিজ্ঞাপন
এদিকে সামুদ্রিক মৎস্য আইনের ১৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ট্রলারের নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক হলেও, এই অনুমোদনে তা উল্লেখ করা হয়নি। নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিস্থাপনযোগ্য ও নতুন ট্রলারের ফিশ হোল্ড ক্যাপাসিটি সর্বোচ্চ ২০০ মেট্রিক টন এবং ভলিউম ৩৪৫ কিউবিক মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু সি রিসোর্সেস লিমিটেডের এই ৬টি ট্রলারের ক্ষেত্রে ৪৪০ কিউবিক মিটার ভলিউমের অনুমোদন দেওয়া হয়। এটি সরকারি নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ট্রলার প্রতিস্থাপনের অনুমোদনে ১০ শতাংশ কম-বেশি করার কোনো বিধান নেই। বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এস এম রশিদুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, মিডওয়াটার ট্রলারকে আধুনিক মিডওয়াটার ট্রলার দিয়ে প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কম-বেশি করার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, জাহাজের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা ও গ্রস টনেজ নির্ধারিত থাকে। সর্বোচ্চ ১ থেকে ২ শতাংশ বিচ্যুতি হতে পারে। কিন্তু ১০ শতাংশ কম-বেশি করার অনুমোদন প্রযুক্তিগতভাবে অসম্ভব। এটি একই সঙ্গে বিপজ্জনকও বলে জানান তিনি।
একই বছরের ১৫ নভেম্বর মেসার্স জালাল করপোরেশনের একটি ট্রলারের অনুমোদনপত্রেও অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। এই অনুমোদনপত্রে স্বাক্ষর করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য-৪ শাখার উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার। এতে কোনো ধরনের স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করা হয়নি।
এটিকেও নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন নেভাল বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে—একটি ট্রলার কী ধরনের মানদণ্ডে এবং কী সাইজে তৈরি হবে, তা অবশ্যই অনুমোদনপত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও তা করা হয়নি। ফলে এখানেও সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩-এর ১৩ (১) ধারাটি সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এদিকে নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন না থাকার কারণে মৎস্য ট্রলার এফ ভি রাঙ্গাচৌকা এবং বটম প্রকৃতির চিংড়ি ট্রলার এফ ভি মাগফেরাত (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এফ-৫০১৮) ও এফ ভি রহমত (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এফ-৬৩৩৮)– এই তিনটি ট্রলারের প্রতিস্থাপনের আবেদন মন্ত্রণালয় ফেরত পাঠায়। এসব আবেদন আরও যাচাই-বাছাই করে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩-এর ১৩ অনুচ্ছেদে প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়। এই তিনটি ট্রলার সংক্রান্ত আবেদন নিয়ে ফিরতি চিঠি পাঠিয়েছেন মৎস্য অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুর রউফ।
এছাড়া নিয়ম না মেনে লং লাইনারে পেলাজিক আহরণের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৬ নভেম্বর, আরও ৫টি লং লাইনার ট্রলারের অনুমোদনে টুনা ও পেলাজিক মৎস্য আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি প্রযুক্তিগতভাবে অসম্ভব। যে কাজের জন্য মিডওয়াটার ট্রলার প্রয়োজন, সেখানে এই ধরনের ট্রলার ঝুঁকি বাড়াবে বলেই মনে করছেন তারা।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের ৩ মে থাইল্যান্ড থেকে ‘এমভি ওয়াইকেপি-১’ নামের একটি ট্রলার তানজানিয়ার পতাকা নিয়ে আসে। এটি দেখতে মাছ ধরার ট্রলারের মতো হলেও, চট্টগ্রাম কাস্টমসের রিপোর্ট অনুযায়ী এটি আসলে একটি খালি কার্গো জাহাজ।
অভিযোগ আছে, রাতে গোপনে জাহাজ থেকে মাল খালাস করে সেটি চট্টগ্রামের ওশান ডকইয়ার্ডে। পরবর্তীতে ওই বছরের ১১ জুন মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে, যারা ৮ জুলাই কার্যক্রম শুরু করে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনেও ‘কার্গো হলেও দেখতে ফিশিং ভেসেলের মতো’ বলার মাধ্যমে এটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়।
এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব (রুটিন দায়িত্বে) মো. তোফাজ্জেল হোসেনকে একাধিকবার টেলিফোন করা হয়েছে। তবে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ট্রলার প্রতিস্থাপনে অনিয়ম-সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে মন্ত্রণালয়ের (ব্লু-ইকোনমি) জোনের সিনিয়র সহকারী পরিচালক ড. মুহাম্মদ তানভীর হোসেন চৌধুরীকে ফোন করা হলে, তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি দেশে নেই। একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাইরে এসেছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন ট্রলার প্রতিস্থাপন-সংক্রান্ত বিষয় তো মনে পড়ছে না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে হয়তো বলা যাবে। কিন্তু এমন অভিযোগ কীভাবে এসেছে, তা বোধগম্য নয়।
বিইউ/এইউ