শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫, ঢাকা

সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্যে অনিশ্চয়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩০ জুন ২০২৫, ১০:৪৮ এএম

শেয়ার করুন:

সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্যে অনিশ্চয়তা

সাংবিধানিক পদে নিয়োগের পদ্ধতি এবং উচ্চকক্ষ গঠনসহ বেশ কিছু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও ঐকমত্য তৈরি হয়নি। গতকাল রোববার (২৯ জুন) অনুষ্ঠিত বৈঠকসহ তিন দফা আলোচনা করেও ব্যাপক মতপার্থক্য থেকেই গেছে। এতে করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আশাবাদী পরিকল্পনা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৈঠকের শুরুতে বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতে (১৬ জুলাই) সবাই মিলে ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করব। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। এ বিষয়ে আমাদের কিছুটা শঙ্কাও রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


দ্বিতীয় দফা আলোচনায় কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত মৌলিক সংস্কারের অন্তত ২০টি বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্য নির্ধারিত হলেও, এখন পর্যন্ত সাত কার্যদিবসে ৯টি বিষয়ের আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি ঐকমত্য হয়েছে মাত্র দুটি প্রস্তাবে—সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন এবং সংসদীয় কমিটিতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়ে।

বাকি প্রস্তাবগুলো হলো— ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সীমিতকরণ ও সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি সংযুক্তি

প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি)’ পরিবর্তে নতুন একটি ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটি’ গঠনের ধারণা উঠে এসেছে। কিন্তু এই প্রস্তাবও সব দলের সমর্থন পায়নি। বিএনপিসহ কয়েকটি দল এই কমিটির বিরোধিতা করেছে। তাদের যুক্তি, সংবিধানে এ ধরনের কমিটি যুক্ত করা হলে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব খর্ব হতে পারে।


বিজ্ঞাপন


বিএনপি জানিয়েছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল ১০ বছর নির্ধারণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী, তবে শর্ত হলো—সংবিধানে ‘নিয়োগ কমিটি’ বা ‘এনসিসি’-র কোনো বিধান রাখা যাবে না।

গতকালের আলোচনায় উচ্চকক্ষ গঠন নিয়েও মতানৈক্য দেখা দেয়। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদের উচ্চকক্ষে একটি দল নির্বাচনে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে আসন পাবে। এই প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এবং আরও কয়েকটি দল সম্মত হলেও বিএনপি এতে একমত নয়। বিএনপির অবস্থান হলো, নিম্নকক্ষে দল যেসব আসন পাবে, তার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন করতে হবে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটা নিম্নকক্ষের রেপ্লিকা হয়ে যাবে। তিনি আরও জানান, তারা নিম্নকক্ষে এখন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর কথা বলছেন না, তবে উচ্চকক্ষে সেটি দরকার।

ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, মৌলিক হলো সংসদের নিম্নকক্ষ। আমরা সেখানে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু সেটা আলোচনায় না আসায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, আমরা এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ, জবাবদিহি এবং ভারসাম্য থাকবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর হাতে যদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে এত মানুষের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন জানান, আলোচনার একপর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলোচনা আটকে যায়। তিনি বলেন, ১১টা থেকে তিন ঘণ্টা আলোচনা করেও অগ্রগতি হয়নি। আমি প্রস্তাব রাখছি—কমিশন আগে বিএনপির অবস্থান জেনে আসুক, পরে আলোচনায় আনুক।

বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে যদি আমাদের শতভাগ একমত হতে হয়, তাহলে আলোচনা কেন? যেসব বিষয়ে সবাই একমত, সেগুলো নিয়েই তো সনদে স্বাক্ষর হওয়ার কথা।

জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এসব প্রস্তাব নতুন নয়। বহুবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দলগুলো একমত হতে পারছে না।

অন্যদিকে গণ–অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, কিছু কিছু দল নিজেদের অবস্থানে একেবারে অনড়। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্য হবে না।

জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে গত বছরের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার নিয়ে প্রস্তাব দেয়। ফেব্রুয়ারিতে তারা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়।

এরপর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলাদা আলোচনা হয়। এরপর জুন থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা। গতকাল রোববারের বৈঠকে অংশ নেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবে বেশির ভাগ দল নীতিগতভাবে একমত। যারা এখনো দ্বিমত পোষণ করেছে, তাদের সংশোধিত প্রস্তাব দেওয়া হবে। আমরা আশা করছি, পরবর্তী বৈঠকে এই বিষয়ে সমাধান আসবে।

তিনি আরও বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে বেশির ভাগ দল একমত। তবে উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত রয়ে গেছে। জুলাই মাসের মধ্যেই আলোচনার চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই। 

উল্লেখ্য, পরবর্তী আলোচনা ২ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন কমিশন সদস্যরা।

এইউ 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর