সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

রেড ক্রিসেন্টে অস্থিরতা, ‘নাটের গুরু’ আ.লীগের সুলতান

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১২ জুন ২০২৫, ০৪:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

রেড ক্রিসেন্টে অস্থিরতা, ‘নাটের গুরু’ আ.লীগের সুলতান

দলীয় ও আত্মীয়করণের পাশাপাশি নিয়ম লঙ্ঘন করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে নিয়োগ দেওয়ায় গত ১৬ বছর মানবিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চলছে যেমন খুশি তেমনভাবে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিয়োগের ক্ষেত্রে বহুবার নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। তেমনি পদোন্নতির ক্ষেত্রেও মানা হয়নি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়মনীতি। বিশেষ করে বিরোধী মতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন পুরোপুরি কোনঠাসা।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পরও আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে পরিচিতরা এখনও আছেন বহাল তবিয়তে। উল্টো আওয়ামী লীগ ঘরানার লোকদের পদোন্নতি, স্থায়ীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে রেড ক্রিসেন্টে। যা নিয়ে অস্থিরতা চলছে প্রতিষ্ঠানটিতে। এসব কাজের পেছনে কারিগর হিসেবে নাম এসেছে ২০২২ সালে নিয়ম ভেঙে উপ-মহাসচিব পদে নিয়োগ পাওয়া সুলতান আহমেদের।


বিজ্ঞাপন


Bangladesh_Red_Crescent_Society,_National_Head_Quarter,_Dhaka
রাজধানীর মগবাজারে ‘বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি’র প্রধান কার্যালয়।

এদিকে রেড ক্রিসেন্টের অভ্যন্তরীণ তদন্তে নিয়ম ভঙ্গ করে নিয়োগের বিষয়টি উঠে এসেছে। সূত্রমতে, রেড ক্রিসেন্টের উপ-মহাসচিব পদে চাকরিতে যোগদান করতে নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থীর বয়স হতে হবে ৫০ থেকে ৬২ বছর। কিন্তু সুলতান আহমেদের নিয়োগের সময় তার বয়স ছিল ৫০ বছর থেকে ৫ মাস কম। মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আব্দুল ওয়াহাবের সময় তিনি নিয়োগ পান। এছাড়াও নিয়োগ পরীক্ষায় আর্থিক কেলেঙ্কারিতেও তার নাম এসেছে।

অভিযোগ আছে, সুলতান ও তার সহযোগীরা মিলে বিগত চেয়ারম্যান এটিএম আব্দুল ওয়াহাবের প্রশ্রয়ে কমপক্ষে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে এবং রেড ক্রিসেন্টে আওয়ামীপন্থী শতাধিক লোককে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে চাকরি, পদোন্নতি ও স্থায়ী করেছেন। ৫ আগস্টের পর কিছুদিন চাপে থাকলেও বর্তমানে আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। রেড ক্রিসেন্টের সক্রিয় ও ত্যাগী কর্মকর্তাদের কোনঠাসা করে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সুলতান আহমদের নেতৃত্বাধীন একটি চক্র।


বিজ্ঞাপন


নিয়ম ভেঙে নিয়োগ পান সুলতান আহমেদ

গত ১৪ নভেম্বর রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ম্যানেজিং বোর্ড সভায় অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত হয়। গত ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে গঠিত ম্যানেজিং বোর্ড পর্যায়ের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. জামিল আহমেদ ইব্রাহিমের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় বলে রেড ক্রিসেন্ট সূত্রে জানা গেছে।

যেখানে বিগত সরকারের আমলে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ ও চাকরি স্থায়ীকরণ, নিয়ম বহির্ভূতভাবে পদোন্নতি, যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিতকরণ এবং যোগ্য ও অভিজ্ঞ চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও RCY-দের চাকরি স্থায়ীকরণ ও বঞ্চিতকরণের বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াহাব কখনও নিজের একক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, কখনো তার ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ঘরোনার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছেন বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, অনুচ্ছেদ-৭, ক-এ উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদের নিয়োগের সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত আবেদনপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ছিল ২০২২ সালের ৭ আগস্ট। কিন্তু তার আবেদনের খামের ওপর তৎকালীন মহাসচিব কর্তৃক গৃহীত হওয়ার তারিখ ২৩ আগস্ট। তাই আবেদন দাখিলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রাপ্ত আবেদনপত্র গ্রহণ করা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যোগ্য করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এছাড়াও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল- ২০২২ সালের ৫ আগস্ট এই পদের প্রার্থীর বয়স ৫০ হতে ৬২ বছরের মধ্যে হতে হবে। কিন্তু সুলতান আহমেদের ছিল ৪৯ বছর ৭ মাস। অর্থাৎ তিনি চাকরিতে আবেদন করারই যোগ্য ছিলেন না।

আবেদনপত্র দাখিলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবেদন গ্রহণ করে তাকে নিয়োগের জন্য যোগ্য করা, বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত বয়সের চেয়ে ৫ মাস বয়স কম থাকা সত্ত্বেও তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নিয়ম বহির্ভূত বলে তদন্ত কমিটি উল্লেখ করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে এমন নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগের জন্য বিগত চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আব্দুল ওয়াহাবকে দায়ী করা হয়েছে। শুধু এই পদেই নয়, তার মেয়াদকালে সিন্ডিকেট করে আরও একাধিক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও প্রমাণ পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

রেড ক্রিসেন্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময় নিয়ম ভেঙে নিয়োগ পাওয়ার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী সরকারের সুবিধাভোগী আখ্যা দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুলতান আহমদের নিয়োগ বাতিল করে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশও করেছে তদন্ত কমিটি। এরআগে উপ-মহাসচিব সুলতান আহমদের অপসারণের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গণস্বাক্ষর শেষে স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন।

এদিকে ২০২২ সালে ‘গ্রিপ’ নামে একটি  প্রকল্পের নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। যেখানে বড় অংকের আর্থিক লেনদেনও হয়েছে। অভিযোগ আছে, উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদের ইন্ধনে তার পিএ ইলিয়াস, পার্সনাল দফতরের মইন, চাকরিচ্যুত আহমেদ নামের একজনকে ব্যবহার করে রেড ক্রিসেন্টের অন্য কর্মকর্তাদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যাতে তৎকালীন বোর্ড সদস্য আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে পরিচিত শাহীন ও টুকু সহযোগিতা করেন। ওই ঘটনায় রেড ক্রিসেন্ট থেকে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি দীর্ঘ তদন্তের পরে গত বছরের ১৪ আগস্ট রিপোর্ট জমা দিয়েছে। জানা গেছে, পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট’ অফিসার পদে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। যেখানে নাম এসেছে সুলতান আহমেদের।

অবশ্য পরবর্তীতে সংস্থাটির চেয়ারম্যান প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করে দেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, এসব অভিযোগের বিষয়ে আপনি যদি বক্তব্য পেতে চান সরাসরি আসতে হবে। টেলিফোনে কোনো বক্তব্য দেব না। দিতে চাই না।

পরে প্রতিবেদক এবং ঢাকা মেইল সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিয়ে তিনি বলেন, আপনার কাছে যদি কোনো রিপোর্ট থাকে সেগুলো নিয়ে অফিস খোলার পরে এসে কথা বলতে পারেন।

নিয়ম লঙ্ঘন করে নিয়োগ, চাকরি স্থায়ীকরণের হিড়িক

এদিকে শুধু উপ-মহাসচিব পদের ক্ষেত্রেই নয়,  আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও নীচের দিকের পদেও নিয়ম ভেঙে, বেআইনিভাবে নিয়োগ দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্তে উঠে এসেছে, নিয়োগের প্রক্রিয়া অর্থাৎ পদবী অনুযায়ী জনবলের চাহিদা, অনুমোদিত বাজেট, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজন এবং চূড়ান্ত অনুমোদন ইত্যাদি ধাপ অনুসরণ না করে সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এটিএম আব্দুল ওয়াহাবের সময় নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রায় ৪০জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের স্থায়ীও করা হয়েছে নিয়ম লঙ্ঘন করে। পরিচালক থেকে শুরু করে বাবুর্চি পর্যন্ত এভাবে নিয়োগ এবং স্থায়ীকরণের আওতায় আনা হয়েছে।

বিইউ/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর