আইন লঙ্ঘন করে মাঠ, পার্ক ও জলাধার ধ্বংস করে জনস্বার্থ বিরোধী এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে ‘জনগণ’।
শুক্রবার (৩০ মে) বিকেলে ‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা’ শিরোনামের এই প্রতীকী মামলার গণশুনানি হয় ঢাকার পান্থকুঞ্জ উদ্যানে (সার্ক ফোয়ারা গেইট)। এর আয়োজক ‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন’।
বিজ্ঞাপন
বিকেল সাড়ে ৩টায় মোকদ্দমা গণশুনানি শুরুর কথা থাকলেও সরেজমিনে দেখা যায় মামলার বিবাদী পক্ষ অর্থাৎ সরকার পক্ষের কেউ উপস্থিত হননি। মাইকে সেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল।
পরে ৪টায় শুনানি শুরু হয়ে দুই ঘণ্টা ধরে চলে ‘কৌঁসুলি ও সাক্ষীদের’ বক্তব্যগ্রহণ এবং সবশেষে ‘রায়’ ঘোষণা করেন ‘বিচারকেরা’।
স্থানীয় মানুষ ও সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণে ভিত্তিতে এবং বিশেষজ্ঞ মতামতের সাপেক্ষে এই গণশুনানিতে প্রকাশ্য রায় দেওয়া হয় এবং সব পক্ষের করণীয় সম্বন্ধে প্রস্তাব করা হয়।
‘বিচারক’ হিসেবে গণশুনানি গ্রহণ করেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য গীতি আরা নাসরীন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামসি আরা জামান, সর্বজনকথার সম্পাদক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
বিজ্ঞাপন
যে কারণে এই গণশুনানি
গণশুনানির আয়োজকেরা জানান, এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত ‘প্রাণ-প্রকৃতি ও জনবিরোধী’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সংযোগ সড়ক প্রকল্প বাতিলের দাবিতে পান্থকুঞ্জ পার্ক এবং হাতিরঝিল জলাধার রক্ষায় পান্থকুঞ্জ পার্কে অবস্থান নিয়ে ১৬৫ দিন ধরে আন্দোলন চলছে।
বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ে এই জনদাবির সাথে সংহতি জানিয়েছে জনগণ, সংগঠন এবং নাগরিক নানা তৎপরতা। অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টা পার্কে এসে কথা দিয়েও গত পাঁচ মাসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসেননি।
গণমাধ্যমে লাগাতার এ বিষয়ে খবর, সরেজমিন প্রতিবেদন, মতামত, ভিডিও, সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে চলেছে। কিন্তু সরকার পান্থকুঞ্জ রক্ষায় এগিয়ে আসেনি, জনদাবিকে গুরুত্ব দেয়নি।
গণশুনানিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি পক্ষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলের ন্যায়বিচারের আর্জি নিয়ে বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন শুক্রবার ‘পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমা: জনগণ বনাম অন্তর্বর্তী সরকার’ শীর্ষক এই গণশুনানি আয়োজন করেছে।

সাক্ষ্যগ্রহণ ও অভিযোগনামা
আদলতের আদলে সাজানো এজলাস, যেখানে কাঠগড়াও ছিল। তার এক পাশে বাদী পক্ষের বসার জন্য চেয়ার দেওয়া হয়। আর অন্য পাশে বিবাদী পক্ষের জন্য চেয়ার রাখা হয়।
গণশুনানিতে জনগণের পক্ষ হতে সরকারের বিরুদ্ধে বাদী পক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে অভিযোগনামা পেশ করেন বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব ও নাঈম উল হাসান।
অভিযোগনামায় প্রকল্পের অর্থনৈতিক কারসাজি ও পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) নীতিমালা ভঙ্গ করা; সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয়; মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবেশ ছাড়পত্র ও শর্তাবলীর লঙ্ঘন; বৈষম্যমূলক চুক্তির ধারা ও জনস্বার্থ বিরোধী দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্প; নাগরিক হত্যা ও বিদেশি কোম্পানির দায়মুক্তি ও প্রকল্পের অজুহাতে পান্থকুঞ্জে গাছ কাটার কারণে পাখি, বাদুড় ও পতঙ্গদের মৃত্যু, প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো ও আশ্রয়হীন করার অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
এরপর বিচারকমণ্ডলীর সামনে সাক্ষ্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান, প্রাণ-প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, পরিবেশকর্মী ও তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক সৈয়দা রত্না, পান্থকুঞ্জ প্রভাতী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সিরাজুদ্দিন তুহিন, শিল্পী ও সংগঠক সৈয়দ মুহাম্মদ জাকির।
সাক্ষ্যগ্রহণের ফাঁকে প্রধান বিচারক গীতি আরা নাসরিন একাধিকবার জানতে চান, বিবাদী পক্ষের কেউ এখানে উপস্থিত আছেন কিনা।
গণশুনানির আয়োজকদের একজন নাঈমুল হাসান বলেন, আমরা বিবাদী পক্ষকে এই গণশুনানির জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা এখানে আসেননি। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ করে, যে তাদের জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
মোকাদ্দমার সাক্ষী নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সরকার এই এক্সপ্রেসওয়েকে বলছে উন্নয়ন, কিন্তু এটা আসলে বিধ্বংসী প্রকল্প। সরকার এখানে ঠিকাদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, জনগণের স্বার্থ দেখেনি।
আরেক সাক্ষী পাভেল পার্থ বলেন, গাছ যে অক্সিজেন দেয়, তাতে একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দুটি গাছের প্রয়োজন হয়। এই পান্থকুঞ্জে ২ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তাতে ১ হাজার মানুষের অক্সিজেন গ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
পান্থকুঞ্জে কী কী গাছ কাটা হয়েছে, তার তালিকাও ‘আদালতে’ তুলে ধরেন তিনি।
এছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এই প্রকল্পে গাছ কাটার কারণে বহু পাখি যে বসবাসের জায়গা হারিয়েছে, তার তথ্য-উপাত্তও হাজির করেন পাভেল পার্থ।

রায় ঘোষণা
সকল পক্ষের প্রমাণ ও প্রস্তাব সাপেক্ষে বিজ্ঞ নাগরিকদের মাধ্যমে গঠিত ‘জনতার আদালত পান্থকুঞ্জ মোকদ্দমার রায়’ ঘোষণা করে।
এই ‘রায়ে’ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, পান্থকুঞ্জ উদ্যান জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ‘ঘোষণা’ করা হয় এবং বাদী পক্ষের অবস্থান কর্মসূচী স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেইসঙ্গে বিবাদী পক্ষসহ অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পান্থকুঞ্জ উদ্যানে জনগণের অবাধ প্রবেশ ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ‘নির্দেশ’ দেওয়া হয়।
আদালতের রায় বাস্তবায়ন এবং বিদেশি কোম্পানির সাথে চুক্তি পুনর্বিবেচনা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সংযোগ সড়কের সকল প্রকার কার্যক্রম স্থগিত ‘ঘোষণা’ করা হয়।
এ সময় আদলত প্রাঙ্গণে উপস্থিত নানা শ্রেণিপেশার মানুষ করতালির মাধ্যমে রায়কে স্বাগত জানান। নাট্যকর্মী, কবি, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রতীকী এই আদালত প্রাঙ্গণে কবি সাঈদ জুবেরী বলেন, কিছুদিন আগেই বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন না করার আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ ছয় মাস ধরে পান্থকুঞ্জ রক্ষার আন্দোলন চলছে, সড়ক অবরোধ না করে, মানুষকে ভোগান্তিতে না ফেলে। কিন্তু সরকার এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
তবে কি সড়ক বন্ধ করে, মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে আন্দোলন করলেই সরকারের কানে পৌঁছায়? সরকার আসলে কোন ধরনের আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে চায়? প্রশ্ন তোলেন সাঈদ জুবেরী।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে কোনো সরকারই প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন না, বরং তারা প্রাণ-প্রকৃতি বিরোধী নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপর। দুঃখজনক হচ্ছে, এই সরকারে প্রাণ-প্রকৃতির বিষয়ে সচেতন কিছু লোকও রয়েছেন। কিন্তু তারাও আগের মতোই প্রাণ-প্রকৃতি বিরোধী কাজ অব্যাহত রেখেছেন।
এফএ

