সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

২৪ দিনে হাজারো পুশইন, চার দফা চিঠিতেও প্রতিক্রিয়া নেই ভারতের

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৯ মে ২০২৫, ০৬:৪৫ এএম

শেয়ার করুন:

২৪ দিনে হাজারো পুশইন, চার দফা চিঠিতেও প্রতিক্রিয়া নেই ভারতের

দেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর ‘পুশইন’ কার্যক্রম থামছেই না। চলতি মে মাসের শুরু থেকেই প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে মানুষজনকে। ৪ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত ২৪ দিনে অন্তত ১৭টি সীমান্ত জেলা দিয়ে মোট ৯৭৫ জনকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে সুন্দরবনের গভীর অরণ্য ঘেঁষা মান্দারবাড়িয়া দিয়ে আরও ৭৮ জনকে ঠেলে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ফলে মে মাসে পুশইনের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।

বিজিবির দেওয়া তথ্যমতে, যেসব জেলাগুলো দিয়ে পুশইন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুশইন হয়েছে মৌলভীবাজার (৩৩১ জন), খাগড়াছড়ি (১১১ জন), সিলেট (১০৩ জন), কুড়িগ্রাম (৮৪ জন), লালমনিরহাট (৭৫ জন), ফেনী (৩৯ জন), ঝিনাইদহ (৪২ জন), মেহেরপুর (৩০ জন) ও সাতক্ষীরা (২৩ জন) জেলায়। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ উল্লেখযোগ্য। সিলেট ও সুনামগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ২৭ মে দিনেই নতুন করে ৮২ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে বিএসএফ। এ ছাড়া লালমনিরহাট দিয়ে পুশইনের চেষ্টা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে বিজিবির কঠোর অবস্থানের কারণে।


বিজ্ঞাপন


বিজিবি জানিয়েছে, পুশইন হওয়া বেশিরভাগ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভারতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। কেউ কেউ ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হয়ে জেলও খেটেছেন। অনেকে বলছেন, তারা ভারতেই জন্মেছেন এবং ভারতীয় নাগরিক। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—ভারত কেন তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে?

বিজিবির মতে, এসব পুশইন কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, সরাসরি সীমান্তে এনে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি রাতে, দুর্গম সীমান্ত পয়েন্ট বা জঙ্গলের ভেতর দিয়েও লোকজন ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। বিজিবি জানিয়েছে, এই কার্যক্রম সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পরিপন্থী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুশইন নিয়ে ভারতকে এ পর্যন্ত অন্তত চার দফা কূটনৈতিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। ৮, ১৩, ১৫ ও ২০ মে তারিখে পাঠানো এসব চিঠিতে বলা হয়, পুশইন কার্যক্রম ১৯৭৫ সালের যৌথ সীমান্ত নির্দেশিকা, ২০১১ সালের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান সমঝোতা লঙ্ঘন করছে। চিঠিতে ঘটনাগুলোকে ‘গভীর উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করে বলা হয়, এটি সীমান্ত নিরাপত্তা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করছে।

কিন্তু ভারত এখনও বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগ আমলে নেয়নি। বরং এক চিঠিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, বাংলাদেশ যে অভিযোগ করছে, তা ভিত্তিহীন এবং প্রমাণবিহীন। তারা উল্টো জানিয়েছে, ২,৪৬১ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য তারা আগেই তথ্য পাঠিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো যাচাই শেষ করেনি। এই অবস্থায় বাংলাদেশ বলছে, বিষয়টি তদন্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।


বিজ্ঞাপন


এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সাধারণত কাউকে জোর করে ফেরত পাঠায় না। তবে যাদের ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের ফেরত নিতেই হবে। তিনি বলেন, আমরা পুশব্যাক করি না। তবে ভারত যদি বৈধ প্রক্রিয়ায় অনুরোধ করে, তাহলে বিষয়টি বিবেচনা করা যায়।

তিনি আরও জানান, সীমান্তে পুশইন বন্ধে ভারতের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে, বাংলাদেশি কেউ অবৈধভাবে ভারতে থাকলে তাদের কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হোক। একইভাবে, বাংলাদেশে যদি কোনো অবৈধ ভারতীয় নাগরিক থাকে, তাদেরও যথাযথ পদ্ধতিতে ফেরত পাঠানো হবে।

বিজিবি জানিয়েছে, পুশইন রোধে সীমান্তে টহল, গোয়েন্দা নজরদারি এবং চেকপোস্টগুলোতে তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকে মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

এদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও জানান, পুশইন হওয়া অনেকের মধ্যে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের কার্ডধারী রোহিঙ্গাও রয়েছে। তিনি বলেন, ভারত রোহিঙ্গাদেরও বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে, যাদের আদি নিবাস মিয়ানমার। তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা, বাংলাদেশে নয়। এ নিয়ে আমরা প্রতিবাদলিপি দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, সীমান্তে এখন কোনো সুরক্ষা ঘাটতি নেই। বিজিবি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে। তবে কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এ ধরনের আচরণ শুধু সীমান্ত সমস্যাই নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশলও হতে পারে। পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল।

সীমান্ত পরিস্থিতির এমন উত্তেজনাপূর্ণ বাস্তবতায় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে, এই ‘অবৈধ পুশইন’ আগামী দিনে আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর