শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভারত থেকে জাহাজ কেনার অর্ডার বাতিল করল বাংলাদেশ

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩ মে ২০২৫, ০৪:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ভারত থেকে নৌবাহিনীর জাহাজ কেনার অর্ডার বাতিল করেছে বাংলাদেশে
ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্সের নির্মিত একটি ফ্রিগেট

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্সে কাছ থেকে ২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের একটি অত্যাধুনিক টাগবোট কেনার চুক্তি বাতিল করেছে বাংলাদেশ, যা নৌবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অর্ডার করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ কেন অর্ডারটি বাতিল করেছে, সে বিষয়ে ভারতীয় সংস্থাটির পক্ষ থেকেও কিছু জানানো হয়নি। এ নিয়ে বাংলাদেশের নৌবাহিনী বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশ সরকারের একটি উচ্চপদস্থ সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, অর্ডারটি যে বাতিল করা হয়েছে সেটি তারাও জেনেছেন। তবে এই সিদ্ধান্ত কেন বা কবে নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে তারা কিছু বলতে পারছেন না!

Screenshot_2025-05-23_164344
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর রণতরী বিএনএস সমুদ্র জয় (ফাইল ছবি)

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে ১৮০ কোটি ভারতীয় রুপির ওই অর্ডারটি পাওয়ার পর সংস্থার শেয়ার দরও একলাফে বেড়েছিল প্রায় দশ শতাংশ। তবে প্রায় বছরখানেকের মাথায় সেটি বাতিল করা হয়েছে বলে সংস্থার পক্ষ থেকে ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জে বুধবার (২১ মে) তাদের ফাইলিং-য়ে জানানো হয়েছে।

এই খবর সামনে আসার পর বৃহস্পতিবার সকালে কোম্পানির শেয়ার বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলেও পরে অবশ্য তারা তা সামলেও নিয়েছে।


বিজ্ঞাপন


পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নেওয়া বহু সিদ্ধান্ত বা আন্তর্জাতিক অর্ডার যেমন এর আগেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাতিল করেছে – গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্সের এই অর্ডার রদ করার সিদ্ধান্তও সেই ধারাবাহিকতায় নেওয়া।

‘ওশান-গোয়িং টাগ’ কী ধরনের জাহাজ?

ওশান-গোয়িং টাগ হল অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষ এক ধরনের জাহাজ, যা মাঝসমুদ্রে বা উন্মুক্ত সাগরেও বিপন্ন জাহাজকে ‘টোও’ করে টেনে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসতে পারে।

এই ধরনের জাহাজকে ‘টাগবোট’ নামেও ডাকা হয়।

টাগ-এর আরেকটি বিশেষত্ব হলো নিজের আকারের তুলনায় অনেক বড় জাহাজকেও এটি টেনে আনার ক্ষমতা রাখে। সামনের দিকে টেনেও আনতে পারে, আবার পেছন থেকে ধাক্কাও দিতে পারে।

পৃথিবীর সব বড় বড় বন্দর ও হারবারে টাগবোট একটি অপরিহার্য অংশ, বিশেষ করে বড় বড় জাহাজের ডকিং ও বার্থিং-এর সময় এই ধরনের ছোট ও শক্তিশালী জাহাজের সাহায্য দরকার হয়।

যে টাগবোটগুলো সাগর বা মহাসাগরে পাড়ি দিয়ে আটকেপড়া জাহাজকে উদ্ধার করতে পারে কিংবা জাহাজের ধ্বংসস্তূপ টেনে আনতে পারে সেগুলোকে বলে ওশান-গোয়িং টাগ।

বাংলাদেশের সঙ্গে গার্ডেনরিচের চুক্তিতে যা ছিল

বাংলাদেশ ভারতীয় কোম্পানিটিকে যে ওশান-গোয়িং টাগ নির্মাণের বরাত দিয়েছিল সেটির দৈর্ঘ্য ৬১ মিটার ও প্রস্থ ১৫.৮ মিটার হওয়ার কথা ছিল।

এটির ডেপথ বা গভীরতা হওয়ার কথা ছিল প্রায় ৭ মিটার। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ‘প্রতিরক্ষা কাঠামো’র সামর্থ্য বাড়ানোই ছিল এই জাহাজটি কেনার উদ্দেশ্য।

পরিপূর্ণ লোড নিয়ে জাহাজটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৩ নটিক্যাল মাইল গতিবেগে যেতে পারবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা ছিল।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টোরেট জেনারেল অব ডিফেন্স পারচেজের সঙ্গে ভারতের এই জাহাজ নির্মাতা সংস্থাটির মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০২৪ সালের ১ জুলাই।

ঠিক তার আগের মাসেই (জুন) তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু'দুবার ভারত সফরে গিয়েছিলেন। প্রথমে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, তারপর চীন সফরে যাওয়ার ঠিক আগে ভারতে আর একটি দ্বিপাক্ষিক সফরে।

Screenshot_2025-05-23_164443
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার শেষ ভারত সফর, ২০২৪-র ২২ জুন

ধারণা করা হচ্ছে জুনের দ্বিতীয়ার্ধে‍ শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ই এই চুক্তি নিয়ে দু’দেশের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। যদিও তখন প্রকাশ্যে কিছু জানানো হয়নি।

চুক্তি অনুয়ায়ী জাহাজটি তৈরি করে সর্বোচ্চ ২৪ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে ডেলিভারি দেওয়া হবে বলেও একটি শর্ত ছিল। ফলে আগামী বছরের (২০২৬) মাঝামাঝি নাগাদ এটি বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিল সংস্থাটি।

কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বছর না ঘুরতেই পুরো অর্ডারটি এখন বাতিল করে দেওয়া হলো।

গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স কারা, কী বানায়?

গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (জিআরএসই) ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রথম সারির জাহাজ নির্মাতা সংস্থা, যারা দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন।

কলকাতায় হুগলী নদীর তীরে গার্ডেনরিচ রোডে অবস্থিত এই সুপ্রাচীন কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ও ব্রিটিশ মালিকানায়, সেই ১৮৮৪ সালে। মার্চেন্ট নেভির জন্য তারা বাণিজ্য জাহাজ বানাচ্ছে প্রায় দেড়শ’ বছর আগে থেকেই।

Screenshot_2025-05-23_164256
মরিশাস কোস্ট গার্ডের জন্য এই জাহাজটি বানিয়েছিল গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স (২০১৩)

 

তবে এখন এটি মূলত ভারতের নৌবাহিনী ও ভারতের উপকূলরক্ষী বাহিনীর (ইন্ডিয়ান কোস্টগার্ড) জন্য রণতরী, ট্যাঙ্কার, বাল্ক ক্যারিয়ার ও প্ল্যাটফর্ম সাপ্লাই ভেসেল তৈরি করে থাকে।

পাশাপাশি বাণিজ্যিক জাহাজ বা কমার্শিয়াল ভেসেল-ও নির্মাণ করে তারা।

তবে ভারতীয় নৌবাহিনীর কোনো সাবেক বা বর্তমান কর্মকর্তাই এই সংস্থার শীর্ষপদে থাকেন, এখন যেমন জিআরএসই-র চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে আছেন কমোডোর পি আর হরি।

গার্ডেনরিচ শিল্পবিল্ডার্স একটি ‘লিস্টেড কোম্পানি’ – যার মানে ভারতের শেয়ার বাজারে এটি একটি নথিভুক্ত সংস্থা, ফলে নিয়মিত ব্যবধানে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে স্টক মার্কেটে তথ্য পেশ করা বা ‘ফাইলিং’ তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

বস্তুত বাংলাদেশ সরকার যে তাদের সঙ্গে ওশান-গোয়িং টাগ নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে এবং পরে সেই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে– এই দুটো তথ্যই জানা গেছে গার্ডেনরিচের স্টক মার্কেট ফাইলিং থেকে!

দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় একজন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলছিলেন, ‘মনে রাখতে হবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় দশ বছর আগে থেকেই একটি সর্বাত্মক প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে – যদিও তার ধারাগুলো ঠিক কী কী, সেটা কখনওই প্রকাশ করা হয়নি বা পাবলিক ডোমেইনে নেই!’

‘তবে এই চুক্তিতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহর আশ্বাস অবশ্যই আছে – এবং আমার ধারণা গার্ডেনরিচকে ওই প্রতিরক্ষা জাহাজ বানানোর বরাত দেওয়া হয়েছিল এই চুক্তির অধীনেই।’

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর