মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়ে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছে বায়রার দুটি পক্ষ। তারা এই শ্রমবাজারে কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেটের ফাঁদে পা না দেয়ার জন্য সরকারকে আহবান জানিয়েছেন।
তাদের একটি পক্ষ মনে করছে, মালয়েশিয়া শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে বিএমইটির অনলাইনে ডাটাবেজ সমৃদ্ধ করে অনলাইন সিস্টেমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে হবে। তাহলে কম খরচে কর্মী পাঠানো সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
আরেকটি পক্ষ বলছে, সরকারের হয়ে একটি গ্রুপ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে বন্ধ করতেই নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। যাতে বিগত সময়ে সিন্ডিকেটের সঙ্গে থাকা সদস্যরাও রয়েছে। কিন্তু তারা আজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলছে।
সোমবার (১৯ মে) দুপুরে শফিকুল কবির মিলনায়তন ও ডিআরইউ ভবনের দ্বিতীয় তলীয় পৃথক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি ও অভিযোগ করেন তারা।
এর আগে, সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে যায়। সকাল ১০টায় সংবাদ সম্মেলন শুরুর পরই বায়রার একটি পক্ষের ওপর অপর পক্ষ হামলা চালায়। হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন বলে দাবি করেছেন তারা। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতাদের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এরপর ডিআরইউ ভবনের দ্বিতীয় তলায় শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন। সংবাদ সম্মেলনে বায়রার একাংশের নেতা ফখরুল ইসলাম গ্রুপ সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা এসময় দাবি করেন, তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে সাজ্জাদ গ্রুপের লোকজন। যারা বিগত সময়ের সিন্ডিকেটের সক্রিয় লোকজন। তবে এ হামলাকে অস্বীকার করেছেন সাজ্জাত গ্রুপের সদস্য আতিকুর রহমনা আতিকসহ অন্যরা।
বিজ্ঞাপন
সংবাদ সম্মেলনে বায়রার একাংশের নেতা ফখরুল ইসলাম বলেন, এ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্নভাবে কাজ করছে। সিন্ডিকেটকে স্পষ্টভাবে না বলার জন্যও উপদেষ্টার প্রতি পরামর্শ রইল। এসময় তিনি মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে যাতে আর কোনো সিন্ডিকেট না হয় সেজন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। সেই সঙ্গে সিন্ডিকেট বন্ধ করে খরচ কমানোর পরামর্শ দেন সরকারে প্রতি।
তার দাবি, বিগত সময়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকাতেও লোকজন মালয়েশিয়া গেছে। কিন্তু ২০ সালের পর এই বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে একটি চক্র, যারা বিগত সময়ে সিন্ডিকেট করে কর্মী পাঠিয়েছে। তবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সবার জন্য উন্মুক্ত করা গেলে সকল রিক্রুটিং এজেন্সি লোক পাঠাতে পারবে বলে অভিমত দেন তিনি।
সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে সরকার কী করতে পারে সেই পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সিন্ডিকেট হওয়ার আগে অভিবাসন কস্ট বেশি ছিল না। ২০০৬-০৭ সালের দিকে মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকায় মালয়েশিয়ায় কর্মী গেছে। গত ২০২০-২২ সালের দিকে যখন সিন্ডিকেট হয়েছে তখন কিন্তু এই খরচটা বাড়ছে। এই সিন্ডিকেটকে অতিরিক্ত দেড় লাখ টাকা দিতে হচ্ছে ফলে খরচতো বাড়বেই। আমরা মনে করছি, সকল রিক্রুটিং এজেন্সিকে যদি উন্মুক্ত করা হয় সেই ক্ষেত্রে সরকার একটা ম্যাকানিজম করতে পারে। সেটা হলো বিএমআইটির যে ডাটাবেজ আছে সেটাকে কাজে লাগাতে পারে। ডাটাবেজটাকে একটিভ করে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক যতো কর্মী আছে তারা সেখানে রেজিস্ট্রেশন করবেন। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ডাটাবেজ থেকে কর্মী নেবে তখন মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকা মধ্যে এই খরচ মেটানো সম্ভব। সেই টাকাটা তারা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দিতে পারে। যে টাকাটা তারা মেডিকেল হওয়ার সময়, ভিসা হওয়ার পরে ও যাওয়ার সময় আরেকটা একাউন্ট দেবে। এভাবে তিন কিস্তিতে তারা টাকা দিয়ে যেতে পারে। এভাবে করলে কর্মীরা কোন দালালের হাত ধরে আসবে না, সিন্ডিকেটও হবে না, বাড়তি টাকাও গুনতে হবে না। ব্যয় তখন কমে যাবে।
ফখরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট চায় না। তারা বরং কিছু কিছু লোককে দিয়ে এ দেশে সিন্ডিকেট করার জন্য চায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যদি না চায় কোনভাবে সিন্ডিকেট হবে না। কারণ, গত সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরে সেই কাজ পেয়েছিল সিন্ডিকেটের সদস্যরা। যেখানে ১০০ জনের সিন্ডিকেট হয়েছিল। যেখানে সালমান এফ রহমানও ছিলেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অনুমোদন ছাড়া সিন্ডিকেট হবে না। নেপাল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাতে তো কোনো সিন্ডিকেট হচ্ছে না। তার মানে কি হলো দুই দেশে এক না হলে সিন্ডিকেট হবে না। আমরা মনে করি বাংলাদেশ সরকার যদি না চায় তাহলে সিন্ডিকেট কোনভাবে হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটের মূল ব্যক্তি দুজন। তারা হলেন— বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন ও মালয়েশিয়ার দাতো সি আমিন। তাদের একটি সিস্টেম আছে। এফডাব্লিউ সিএমএইচ সিস্টেম। এটা তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। যেটার মালিকও তারা। ওনারা বিগত সময়ে যেসব ব্যক্তিদের নিয়ে সিন্ডিকেট করেছিল তাদের নিয়ে আবারও সক্রিয়। তারা মেজর মাসুদ, ফেনীর সাবেক এমপি নিজাম হাজারী, সাবেক মন্ত্রী লোটাস কামাল, যুবলীগ নেতা মহিউদ্দিন মহিসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়েই তারা সিন্ডিকেট করেছিল। এখনো সেই নেতারা সিন্ডিকেট করছেন। যারা ৫ আগস্টের পর যারা দেশ থেকে পালিয়েছে তারা এই সিন্ডিকেটে থাকছে। তাদের সঙ্গে নতুন কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এটার সঙ্গে আছেন। তারা এখন নানাজনের নাম বিক্রি করছেন। তারা এও বলছেন, তারা নাকি আসিফ নজরুলকে ম্যানেজ করে ফেলছেন। এও বলছেন। এই শব্দটা তারা ব্যবহার করছেন। শুধু তাই নয়, তারা বিএনপির মহাসচিবকেও ম্যানেজ করে ফেলছে বলছে। কিন্তু আমরা এটা বিশ্বাস করি না, এটা সম্ভবও না।
ফখরুল গ্রুপের সংবাদ শেষের পরই শফিকুল কবির মিলনায়তনে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে বায়রার আরেকটি পক্ষ সাজ্জাদ গ্রুপ। এ গ্রুপের সদস্যদের পক্ষ থেকে আতিকুর রহমান আতিক নামে এক নেতা অভিযোগ করেন, যারা আজকের সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল তারা ভারতের স্বার্থকে হাসিল করার জন্য ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে বন্ধ করতে চায়।
সংবাদ সম্মেলনে মেজবাহ উদ্দিন সেলিম নামে এক বায়রার সদস্য অভিযোগ করেন, এসকল স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ নিজের স্বার্থের বাইরে কোন কিছু চিন্তা করতে পারেন না। দেশের অভ্যন্তরে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা চালানো এবং মানব পাচার ও মানি লন্ডারিং এর মতো মামলা-মোকদ্দমায় ইন্ধন যুগিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রিপোর্ট প্রেরণ করেছেন। এতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের টিআইপি র্যাংকিয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলশ্রুতিতে দেশের রপ্তানি খাত এবং জনশক্তি সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মালয়েশিয়া সরকার ইতোমধ্যে অন্যান্য সোর্স কান্ট্রি থেকে কর্মী নিয়োগ শুরু করলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসকল মামলা-মোকদ্দমার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে অনীহা প্রকাশ করছে।
এই প্রেক্ষিতে সরকারের উচিত হবে এসব কুচক্রী মহল ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গের কথায় প্রভাবিত না হয়ে মালয়েশিয়া সরকারের অনুসৃত নীতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে স্বল্প ব্যয় ও নিরাপদ অভিবাসনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেদেশে কর্মী প্রেরণের ব্যবস্থা করা। অন্যথায় মালয়েশিয়া সরকার অন্যান্য সোর্স কান্ট্রি হতে প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ করবে। ফলশ্রুতিতে মালয়েশিয়ার অতীব সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীগণ বৈধভাবে গমন করতে পারবেন না। এতে করে অবৈধভাবে বা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে গমনের মতো ঘটনা ঘটবে, যার পরিণাম হিসেবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য দীর্ঘ দিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারের সিদ্ধান্তহীনতাই এজন্য দায়ী হবে।
এমআইকে/এমএইচটি

