দেশের রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ এবং প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) বুঝতে পারছে, এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার নিশ্চিত না করা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উভয়দিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হালনাগাদকৃত নতুন ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ভোটার তালিকা আইন এবং ভোটার তালিকা বিধিমালায় সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে ইসি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, তরুণদের ভোট গণনার বাইরে রেখে নির্বাচন আয়োজন রাজনৈতিকভাবেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। কারণ এই শ্রেণির ভোটারদের একটি বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় এবং তারা রাজনৈতিক প্রচারণায় বড় ভূমিকা রাখে। এ প্রেক্ষাপটে ইসি ভোটার তালিকা আইন ও বিধিমালায় সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে বছরের যেকোনো সময় খসড়া ও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের ক্ষমতা কমিশন হাতে পায়। সংশোধনী অনুমোদিত হলে নতুন ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের পথ সুগম হবে। আইন সংশোধন হলে প্রতিবছর ২ জানুয়ারি খসড়া ভোটার তালিকা এবং ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি বছরের যে কোনো সময়ে হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পাবে সংস্থাটি।
বিজ্ঞাপন
ইসি সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে ভোটার রয়েছে ১২ কোটি ৩৭ লাখের বেশি এর মধ্যে এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সের ভোটারদের তরুণ ধরা হয়েছে যাদের সংখ্যা ৩ কোটি ৫ লাখ এর সঙ্গে আরও চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ শেষে যুক্ত হবে আরও প্রায় ৫৯ লাখের বেশি। এতে মোট তরুণ ভোটার সংখ্যা দাঁড়াবে ৪ কোটির কাছাকাছি যা মোট ভোটারের ৩০ শতাংশ এবং একযোগে ২১ লাখের বেশি মৃত ভোটার শনাক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচনের আগে সময়মতো তালিকা হালনাগাদ করা না হলে একদিকে যেমন নতুন ভোটার বঞ্চিত হবেন, অন্যদিকে মৃত ভোটারদের নাম থেকে গিয়ে আইনি জটিলতার আশঙ্কা থাকবে।
ইসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে ভোটার তালিকা হালনাগাদ নিয়ে তৈরি হতে পারে নতুন আইনি জটিলতা। কারণ, বর্তমান আইনের বিধান অনুযায়ী, হালনাগাদে যুক্ত হওয়া নতুন ভোটারদের খসড়া তালিকা প্রকাশের তারিখ ২ জানুয়ারি, আর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের সময় নির্ধারিত ২ মার্চ। ফলে এই সময়ের আগে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে অনেক নতুন ভোটারই ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। একইসঙ্গে মৃত ভোটারদের নাম তালিকায় থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে, যা নির্বাচনকে ঘিরে প্রশ্ন তুলতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, নির্বাচন কমিশনের আইন সংস্কার সংক্রান্ত কমিটি ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা আইন সংশোধনের প্রস্তাব তৈরি করেছে, যা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনী পাশ হলে, কমিশনের নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী বয়স ১৮ বছর হওয়া নাগরিকরাও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভোট দিতে পারবেন।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার ঢাকা মেইলকে বলেন, এটি এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। ভোটার তালিকা আইন ও বিধিমালা সংশোধনের বিষয়টি আগামী কমিশন সভায় চূড়ান্ত হবে।
তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি যেন তফশিল ঘোষণার আগেও যারা ১৮ বছর পূর্ণ করবেন, তারা যেন ভোট দিতে পারে। এজন্য ভোটার নিবন্ধন আইনে সংশোধন আনার কথা ভাবা হচ্ছে। এতে ভোটার হওয়ার শেষ সময় হতে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ।
এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ভোটার তালিকা অপরিহার্য। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ ঘরে ঘরে গিয়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছে। আমরা সন্তুষ্ট, আমাদের টার্গেট ছিল ৬১ লাখ ৮৮ হাজার নতুন ভোটার নিবন্ধিত হবে। দেখা যাচ্ছে ৪৩ লাখের উপরে বাদ পড়া ভোটার নিবন্ধিত হয়েছে। নতুন হয়েছে ১৯ লাখ ৬৬ হাজার। মোট ৬৩ লাখ ভোটার নিবন্ধিত হয়েছে। আমরা আশাকরি জুনের মধ্যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকাটি পেয়ে যাব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তফশিল ঘোষণার আগেও অনেকের বয়স ১৮ হবে। তারাও ভোট দিতে চায়, এবার এই তরুণরা নতুন ভোটার হবে। নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ হবে তাদের যেন আমরা ভোটার তালিকায় যুক্ত করতে পারি এবং তারা যেন ভোট দিতে পারে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের ভূমিকা তুলে ধরে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জুলাই-আগস্টে তরুণরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ইতিহাস গড়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন তারা। একইসঙ্গে আন্দোলনে নেমে যারা মারা গেছেন ও আহত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ। সুতরাং আগামীতে বাংলাদেশে ফের যেন কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারের উত্থান না ঘটে, সেজন্য তরুণদের ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে সংস্কার ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।
কমিশন সূত্র জানায়, ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ এর ৩ ধারার উপধারা (জ) এবং ১১ ধারার ১ উপধারায় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধনীতে এমন ভাষা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন অনুযায়ী ভোটার যোগ্যতা অর্জনের তারিখ এবং তালিকা সংশোধনের সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীর মূল বিষয়গুলো:
ধারা ৩(জ): ভোটার যোগ্যতা অর্জনের তারিখ হিসেবে ১ জানুয়ারির পরিবর্তে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত অন্য তারিখ নির্ধারণের সুযোগ থাকছে। ধারা ১১(১): ২ জানুয়ারি থেকে ২ মার্চ সময়সীমা ছাড়াও কমিশনের বিবেচনায় ‘উপযুক্ত সময়’ উল্লেখ করে নমনীয়তা আনার প্রস্তাব রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন আগামী ডিসেম্বরকে টার্গেট করলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে একাধিকবার বলেছেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে নিয়ে পরের বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে সেটা ঠিক কোন মাসে হবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে সরকারের পক্ষ থেকে আজও বলা হয়নি। বিভিন্ন মহল থেকে এই সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার দাবি ওঠায় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আরও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এমএইচএইচ/এএস