শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

সাত দিনে ১১ জেলায় সংঘাত-সংঘর্ষের নেপথ্যে কী?

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৪ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img
শরীয়তপুরের জাজিরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ। শনিবার সকালে বিলাসপুর ইউনিয়নের দূর্বাডাঙ্গা এলাকায়

সারাদেশের অন্তত ১১টি জেলায় সংঘাত- সংঘর্ষ, সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া গেছে গত এক সপ্তাহে। জেলা, উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত স্থানীয় বিভিন্ন পক্ষ বা গোষ্ঠীর মধ্যে দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা কেন বাড়ছে, থামানো যাচ্ছে না কেন- এসব প্রশ্ন নতুন করে সামনে আসছে।

পুলিশ বলছে, ‘আধিপত্য বিস্তার’ নিয়ে এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের দাবি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। এছাড়া এ ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ আগেও ঘটেছে বলে দায় এড়াতে চাইছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে।


বিজ্ঞাপন


তাদের মতে, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এর মধ্যে নানা ধরনের অপরাধ বেড়েছে; আর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জেলা-উপজেলা, এমনকি গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন পক্ষ বা গোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।

স্থানীয় পর্যায়ে সংঘর্ষ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার কিছুটা চিত্র পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে।

সেখানে দেখা যায়, শরিয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার এক গ্রামে ফাঁকা ফসলের মাঠে দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। তাদের অনেকের হাতে বালতি ভর্তি ককটেল, আর মাথায় হেলমেট। তারা বালতি থেকে হাতবোমা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে । সেগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করছে। এই ভিডিওটি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের কাজিয়ারচর এলাকার।

সেখানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক হাতবোমার বিস্ফোরণের কথা জানিয়েছে পুলিশ।


বিজ্ঞাপন


পুলিশ জানায়, বিলাসপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার সমর্থকদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। এ নিয়ে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়াচ্ছে এই দুই পক্ষ।

সংঘাত-সংঘর্ষের পেছনে আসলে কী

একই দিনে গতকাল শনিবার মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও রংপুরেও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাত- সংঘর্ষের খবর প্রকাশ হয়েছে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়নে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নারীসহ ১৫ জন আহত হয়েছে।

মাদারীপুরে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের হামলায় এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মারাত্মক জখম হয়েছেন।

অন্যদিকে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত একজন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছেন।

এর আগে ৪ এপ্রিল মাদারীপুরের কালকিনিতে আধিপত্য বিস্তারের জেরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ব্যাপক ভাঙচুর এবং এলোপাতাড়ি কুপিয়ে একজনের হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে ফেলার খবর পাওয়া যায়।

13
বুধবার (২ এপ্রিল) সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় তারাবির নামাজের হাদিয়ার টাকার হিসাব নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছে দুটি পক্ষ।

এর আগের দিন ৩রা এপ্রিল ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।

সেদিনই নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া ভোলার চরফ্যাশনে স্থানীয় দুই প্রভাবশালী গ্রুপের দফায় দফায় সংঘাতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন বলে পুলিশ সাংবাদিকদের জানিয়েছে।

হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জে পৌর যুবদল নেতার ফেসবুক পোস্টে মন্তব্যের জেরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন।

এর আগে ০১ এপ্রিল মঙ্গলবার সিলেটে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও যুবদলের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।

ওইদিন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্ব বশিকপুর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই প্রভাবশালী গ্রুপের গোলাগুলির ঘটনায় এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়।

এই আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় দিনব্যাপী সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৪৫ জন।

এর আগে ৩১ মার্চ গাজীপুরের টঙ্গীতে এরশাদ নগর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও মারধরের ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে এসব তথ্য জানা যায়।

মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, চাঁদাবাজির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে বা আধিপত্য ধরে রাখতে বিভিন্ন পক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।

12
সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের পর আজ রোববার সকালে শরীয়তপুরের জাজিরার বিলাসপুর এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। 

‘অপরাধ কী একেবারে জিরো হয়ে যাবে’

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ অস্থির ও অনিয়ন্ত্রিত বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা দাবি করলেও পুলিশ বলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। এ ধরণের সংঘাতের ঘটনা আগেও ঘটেছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন,পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, এটা আমি মনে করছি না। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অস্থিরতা বরাবরই ছিল।

বাহারুল আলম এও বলেন, অপরাধ কী একেবারে জিরো হয়ে যাবে? কোনো ঘটনাই ঘটবে না? সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিছু ঘটনা ঘটবে, কিছু অস্থিরতা থাকবে। আমরা তো ব্যবস্থা নিচ্ছি।

নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা অন্যতম চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেন, নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসবে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাত ততো বাড়তে পারে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও সহিংসতার দিকে যেতে পারে। এটা বিবেচনায় রেখেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের দেশে এমন কোনো নির্বাচন নেই, যেখানে একটা লোকও মারা যায়নি। আমরা এমনটা দেখে অভ্যস্ত। এটা আমাদের সমাজের চরিত্র। এগুলো হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে, সব শান্তিপূর্ণ হয়ে যাবে- এমনটা আশা করা যায় না।

তিনি আরও বলেন, এগুলো নিয়েই আমাদের চলতে হবে। নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসবে পরিস্থিতি আরও সহিংস হবে। সেটা মাথায় রেখেই আমরা কৌশল ঠিক করছি। মানুষ যেন সমাজকে অস্থির করে না ফেলে আমরা সেটাই চেষ্টা করছি।

হঠাৎ সামাজিক পরিবর্তন

সমাজ যখন হঠাৎ কোনো পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন এমন অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ বি এম নাজমুস সাকিব। তার মতে, সমাজে যখন হঠাৎ কোন পরিবর্তন আসে তখন মানুষ সহজে তা মানিয়ে নিতে পারে না। যা বিশৃঙ্খলাকে উস্কে দেয়।

তিনি বলেন, আগে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলাতো। সেটার মানসিক প্রস্তুতি ছিলো। তখন সংঘাত হলেও সেটা দ্রুত মানিয়ে নেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এবার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন একটা আকস্মিক পরিবর্তন। এ ধরনের পরিবর্তনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সবাই মনে করে আমি এই আন্দোলনের অংশ; সুতরাং সব আমার মতো হবে। অন্যের মতামত গ্রাহ্য করা হবে না। এক কথায় মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টা থাকে না।

তবে গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে রোডম্যাপ থাকে। রোডম্যাপ থাকলে দলগুলো সতর্ক থাকে। কিন্তু এখন কোনো রোডম্যাপ নেই। তাই আধিপত্য বিস্তারে মানুষ সহিংস হয়ে পড়ছে বলে তিনি মনে করেন।

‘নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততোই সহিংসতা বাড়বে’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শাহারিয়া আফরিনের মতে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনাও তত বাড়তে থাকবে। তার মতে, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় না থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে।

শাহারিয়া আফরিন বলেন, সবাই নিজেকে রাজা মনে করে পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। একারণে এখন অনেকেই অরাজকতা করার সাহস পাচ্ছে।

তিনি বলেন, আগে শুধুমাত্র একটি দল আধিপত্য বিস্তার করায় অন্য দলগুলো তাদের ক্ষমতার চর্চা বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারেনি। কিন্তু এখন সবাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থা আগের মতো কার্যকর নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। এ কারণে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেইসাথে মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাব দেখা দিয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা কমে যাওয়ায় কেউ আর সামাজিক রীতি নীতির তোয়াক্কা করছে না। সমাজের মানুষের মধ্যে যে মেলবন্ধন বা বিশ্বাসের জায়গা, সেখানে ফাটল দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও দেশপ্রেম থেকে মানুষ ছিটকে পড়ছে। যা অপরাধকে উস্কে দিচ্ছে। মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত এমন পরিস্থিতির দৃশ্যত কোন পরিবর্তন হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

পুলিশের মনোবল ফেরানো জরুরি

পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার বিষয়ও সাম্প্রতিক বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সংঘর্ষের পেছনে আরেকটি বড় কারণ বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ বি এম নাজমুস সাকিব।

তিনি জানান, পুলিশের মনোবল ভেঙে গিয়েছে। এছাড়া পুলিশের বাহিনীর ভেতরে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। পুলিশ সোর্স নিয়ে কাজ করে। কিন্তু বদলির কারণে তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে গিয়েছে। এ সব কারণে কোনো কিছু ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, পুলিশ যে মনোবল হারিয়েছে, সেটা দ্রুত ফিরিয়ে আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেনাবাহিনী মাঠে আছে ঠিকই, কিন্তু তারা সংখ্যায় কম। তাছাড়া সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাই পুলিশকে শক্তিশালী করা খুব জরুরি।

তবে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি এখন থেকে নিয়ন্ত্রণে আনা না হলে নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসবে, এই ধরনের রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সূত্র: বিবিসি বাংলা

/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন