বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

এবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম, ‘জনজীবন দুর্বিষহের’ শঙ্কা

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১২ জুন ২০২২, ০৮:৩৪ এএম

শেয়ার করুন:

এবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম, ‘জনজীবন দুর্বিষহের’ শঙ্কা

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি যেন থামছেই না। চাল, ডাল ও তেলসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে যখন সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ঠিক সেই সময় বাড়লো গ্যাসের দাম। আর এ গ্যাসের দাম বাড়ার মধ্য দিয়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিশ্লেষকদের মতে, এ অবস্থা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। এমন সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণ মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে।

গেল ৫ জুন রোববার আবাসিক খাতে গ্যাসের দুই চুলার দাম ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৮০ টাকা করা হয়েছে। আর এক চুলার দাম ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বর্তমান দর ১২ দশমিক ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা করেছে কমিশন। চলতি মাস থেকেই নতুন এই দর কার্যকর হবে।


বিজ্ঞাপন


এছাড়াও অন্যান্য গ্রাহকশ্রেণি যথা: বিদ্যুৎ (সরকারি, আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র); ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট, স্মল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র); সার; শিল্প; চা-শিল্প (চা-বাগান); বাণিজ্যিক (হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য) এবং সিএনজির ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে (মাসিক অনুমোদিত লোডের বিপরীতে) ০ দশমিক ১০ টাকা হারে ডিমান্ড চার্জ প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুতে প্রতি ঘনমিটার ৫ দশমিক ২ টাকা, ক্যাপটিভ ও সার কারখানায় ১৬ টাকা, শিল্পকারখানায় ১১ দশমিক ৯৮ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১ দশমিক ৭৮ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০ দশমিক ৭৮ টাকা, চা শিল্পে ১১ দশমিক ৯৩ টাকা, বাণিজ্যিক ২৬ দশমিক ৬৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে ফিড গ্যাস সিএনজির দাম, ৪৩ টাকা।

“বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের দামও বাড়বে। তবে সেটি কত ভাগ বাড়বে তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় থাকাতে ভর্তুকির পরিমাণ দিন দিন বাড়াতে হচ্ছে।”

এদিন বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু ফারুক বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ২২(খ) ও ৩৪ এ প্রদত্ত দায়িত্ব ও ক্ষমতাবলে গ্যাস কোম্পানিগুলোর আবেদনের ভিত্তিতে গণশুনানি করা হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহার পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব সংবলিত আবেদনের বিষয়ে আগ্রহী পক্ষগণকে শুনানি প্রদানপূর্বক সকল তথ্যাদি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণান্তে ওই লাইসেন্সসমূহ কর্তৃক ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন এই মূল্যহার পুনঃনির্ধারণ করা হলো।

তিনি আরও জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুতের দামও বাড়বে। তবে সেটি কত ভাগ বাড়বে তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় থাকাতে ভর্তুকির পরিমাণ দিন দিন বাড়াতে হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানির সিদ্ধান্ত আসার আগেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ প্রস্তাব জানিয়েছে তারা। এনিয়ে ১৮ মে গণশুনানিও করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

বিপিডিবির প্রস্তাব- সরকার ভর্তুকি না দিলে পাইকারি মূল্যে প্রতি ইউনিটে ২ টাকা ৯৯ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য দাঁড়াবে ৮ টাকা ১৬ পয়সায়। তবে এই খাতে সরকার ভর্তুকি দিলে দাম অপরিবর্তিত (প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ১৭ পয়সা) থাকবে। বিপিডিবির মতে- গ্যাসের বর্তমান দাম বিবেচনায় বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯ টাকা ১৪ পয়সা প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯ টাকা ২৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে জনগণের ওপর ভয়াবহভাবে এর প্রভাব পড়বে। সাধারণ ও মধ্যবিত্তের জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ।

সব মিলে বুঝাই যাচ্ছে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে নিশ্চিত। এখন সেটা দিন ক্ষণের অপেক্ষা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে জনগণের ওপর ভয়াবহভাবে এর প্রভাব পড়বে। সাধারণ ও মধ্যবিত্তের জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কিছুতেই ঠিক হবে না। সরকারের হাতে অনেক বিকল্প আছে। সরকার সেগুলা কাজে লাগাতে পারে। যদি এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ায় তবে এর ভয়ানক প্রভাব পড়বে। এতে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। গ্যাস বিদ্যুত ছাড়া তো মানুষ চলতে পারবে না। এজন্য গ্যাস বিদ্যুতের ব্যয় যোগান দিতে গিয়ে যার প্রভাব খাদ্যের ওপর পড়বে। খাদ্যে ব্যয় কমিয়ে দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে এগুলোর প্রভাব অন্য জিনিসের ওপরও পড়বে। সবমিলে চাপটা সাধারণ মানুষেরই ওপর পড়বে বেশি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলে, ‘এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে এর প্রভাব পুরোটাই জনগণের ওপর পড়বে। মানুষ আরও দারিদ্র হবে। মানুষের দুঃখ কষ্ট আরও বাড়বে, জনজীবন দুর্বিষহ হবে।

তিনি বলেন, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বোর্ডের ১১ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি। সরকার এক বছরে গচ্ছা দিচ্ছে ২৭১ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি দেওয়া হবে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে এগুলো উৎপাদন করতে পারছে না। এই যে এসব অর্বাচিন কাজ করে এটা দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষের ওপর। বিল বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিজের আপনজনদেরকে এসব ফায়দা দেওয়া হচ্ছে।

সুজন সম্পাদক আরও বলেন, সরকার তো এসব কেয়ার করে না। নির্বাচনের সরকারের তো ভোটের দরকার নাই। তাই মানুষে কি মনে করলো তাতে কি আসে যায়!

ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের (এফইআরবি) ভাইস চেয়ারম্যান সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি অনুরোধ করবো সরকার যেন বিদ্যুতের দাম না বাড়ায়। না বাড়ানোর পেছনে আমার যুক্তি হচ্ছে বিদ্যুতের দাম বাড়লে অনেক রকম প্রভাব পড়তে পারে। যার মধ্যে একটা হচ্ছে শহরাঞ্চলে অনেক বাসা আছে যেখানে মানুষ ভাড়া থাকে অনেকেই দুই তিনজন মিলে একটা মিটার ব্যবহার করে। সেখানে বাড়িওয়ালা তাদের কাছ থেকে ইউনিট হিসেবে একটা বিল নির্ধারণ করে দেয় সে হিসেবে বিল নেয়। এখন ধরুন বিদ্যুৎ বিল যদি এক হাজার টাকাও বাড়ে বাড়িওয়ালা তিন জনের কাছে তিনশত টাকা বেশি নেবে। যেখানে ভাড়াটিয়াদের কিছু করার থাকে না। শিল্প খাতে তো একটা বড় প্রভাব আছেই।

তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের ভোক্তা কিন্তু দেশের প্রত্যেকটা মানুষ। তার মানে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ১৬-১৭ কোটি মানুষের উপর এর প্রভাব পড়তেছে। সরকারের কাজ হচ্ছে জনগণের কল্যাণ করা। সরকারের হাতে অনেক বিকল্প আছে। সরকার চাইলে অন্য জায়গা থেকে ব্যবস্থা করতে পারে।

এদিকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি বছরে (২০২১-২০২২) ছিল ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ  ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৪১৮ কোটি টাকা কম পাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

টিএই/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর