পুরান ঢাকা এলাকায় রোজই দেখা মেলে ঘোড়া দিয়ে টানা ব্রিটিশ ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ির। কোচয়ানের (টমটম চালক) হাঁকডাকে নগরীর ব্যস্ততম রাস্তার বুক চিরেই টমটম গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে দেয় সওয়ারিকে। কেউবা আবার শখের বসেই এই টমটম গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ান। তবে ব্রিটিশ ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।
টমটম গাড়ি বয়ে বেড়ানো ঘোড়াগুলোর সঠিক পরিচর্যা নেওয়া হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ঘোড়াগুলোর পিঠে ফুটে ওঠা চাবুকের আঘাতের চিহ্ন জানান দেয় তাদের প্রতি অমানবিক আচরণের। এছাড়া সঠিক সময়ে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার না দিয়ে অযত্ন-অবহেলায় ঘোড়াগুলোও মারা যাচ্ছে। এসব কারণে গত ছয় মাসে মারা গেছে দুটি ঘোড়া। এতে বহু পুরনো এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা যেন মুশকিল হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞাপন

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৬ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ঘটে, যা তখন ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। সেই সময়ে গাড়িগুলো বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন: বিয়ের অনুষ্ঠান, খাৎনার অনুষ্ঠান, সিনেমার শ্যুটিং কিংবা বড় বড় ব্যক্তিদের আগমনে ব্যবহার করা হতো।
তবে বর্তমানে রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকায় পরিবহন কাজে ব্যবহৃত হয় ঘোড়ায় টানা গাড়ি টমটম। এটি আজও বেশ প্রচলিত একটি অযান্ত্রিক বাহন। এখন টমটম গাড়িগুলো ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত যাত্রীর বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জনপ্রতি ভাড়া ২৫ টাকা।
সম্প্রতি সুমনা খাতুন নামে টমটমের এক যাত্রীর সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা শখের বশে টমটম গাড়িতে উঠি। কিন্তু এই টমটম গাড়ির ঘোড়াদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হয় না। সঠিকভাবে খাবার দেওয়া হয় না। অনেক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ, ঘোড়াদের প্রতি এই অমানবিক আচরণ বন্ধ করা দরকার।
বিজ্ঞাপন

টমটম গাড়ি বয়ে বেড়ানো ঘোড়াগুলোর প্রতি অযত্ন ও অবহেলার কথা উঠে এসেছে খোদ কোচয়ানদের (টমটম চালক) কথাতেও। হাসান নামে এক কোচয়ান বলেন, আমরা এখানে পেশাদারভাবে গাড়িগুলো চালাই। আমাদের মালিক পক্ষ আছে, যারা আমাদের টমটম চালানোর বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেয়। তবে ঘোড়াগুলোর যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করলেও আমাদের তেমন সুযোগ হয়ে ওঠে না।
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অনির্বান সরকার বলেন, আমার মতে- টমটম গাড়ি চালানো ঠিক নয়। কিন্তু এটা যেহেতু একটি ঐতিহ্যবাহী জিনিস, সেহেতু এটি বিকল্প কোনো রাস্তায় চালানো যেতে পারে। যেখানে বাস, ট্রাক, সিএনজি ইত্যাদির চাপ থাকে না শুধু সেখানে টমটম গাড়িই চলবে। যেটা আমরা বিদেশে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই।
অধ্যাপক ড. অনির্বান সরকার বলেন, যারা টমটম চালায় তারা ঘোড়াকে প্রাণি মনে না করে ইঞ্জিন মনে করে টমটমে যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতা চালায়। কখনো কখনো যাত্রীর সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ জন হয়ে যায়। ঘোড়া অবলা প্রাণি বলে এরা কথা বলতে পারে না। প্রায়সময়ই দেখা যায়- টমটমের সঙ্গে বাস বা অন্য যানবাহনের ধাক্কা লাগলে ঘোড়া শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় আমরা দেখতে পাই গাড়ির সঙ্গে আঘাত পেয়ে ঘোড়ার চামড়া ফুটো হয়ে যায়, রক্ত বের হয়, এগুলো খুবই অমানবিক।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, বাস-ট্রাক জড়বস্তু দিয়ে তৈরি, কিন্তু ঘোড়ার অনুভূতি আছে, সে একটি প্রাণি। এ জন্য ঘোড়াগুলোকে দ্রুততম যানবাহন চলাচলের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। যারা ঘোড়াগুলোর দেখাশোনা করে, তারাও ঘোড়ার প্রতি তেমন যত্নবান নন। একটি ঘোড়ার দৈনিক কী পরিমাণ খাবার প্রয়োজন, পানি প্রয়োজন এগুলো তারা নিশ্চিত করতে পারেন কি না সন্দেহ আছে। তাছাড়া ঘোড়া অসুস্থ হলে তাদের কীভাবে শুশ্রূষা করতে হবে এ বিষয়েও ঘোড়ার মালিকরা উদাসীন। এসব কারণে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা হুমকির মুখে রয়েছে।
/আইএইচ

