বাংলাদেশ সফরে এসে টানা দুই দিন কর্মব্যস্ততা সময় পার করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। শনিবার বিকেলে সফরের বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে এ দেশের গণতন্ত্র, সংস্কার ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন।
সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, নতুন বাংলাদেশে সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেখানে প্রধান সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত আছে জাতিসংঘ।
বিজ্ঞাপন
সফরে জাতিসংঘ মহাসচিবের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি তার সমর্থন ও সহমর্মিতা জানানো। তাই সফরের শেষ সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাবও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।’
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, এটি বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ উভয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে সফল করতে সাহায্য করবে।
এর আগে শনিবার ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচিতে যোগ দেন জাতিসংঘ মহাসচিব। গোলটেবিল বৈঠকে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যু গুরুত্ব পায়।
বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু তা দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে বলেছি আমরা।’
বিজ্ঞাপন
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, তাদের দল সংস্কার, সুষ্ঠু নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্য নিয়ে কথা বলেছে।
সংস্কারে সহযোগী হবে জাতিসংঘ
বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকায় পৌঁছান জাতিসংঘ মহাসচিব। শুক্রবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে 'সলিডারিটি ইফতার' করেন। পরদিন শনিবার ঢাকার গুলশানে জাতিসংঘের নতুন ভবন উদ্বোধনসহ নানা কর্মসূচিতে যোগ দেন আন্তোনিও গুতেরেস।
দুপুরে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তিনি। এ সময় বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগ ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি জনগণের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রত্যাশাকে স্বীকার করি।’
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আপনাদের ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে সমর্থন জোগানো।’
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ইস্যুতে বাংলাদেশ জাতিসংঘকে প্রধান সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করতে পারে বলেও যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানান গুতেরেস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত করতে চাই যে শান্তি বজায় রাখতে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের এক নম্বর সহযোগী হিসেবে গণ্য করতে পারেন আপনারা। আমরা সবার জন্য একটি ন্যায্য এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চাই।’
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কী?
যৌথ সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে কথা বলেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আতিথেয়তাকারী বাংলাদেশি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্যই আমি বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি’।
আগামী মাস থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমে গেলে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
শুক্রবার রোহিঙ্গাদের সাথে ইফতার অনুষ্ঠানে গুতেরেস স্পষ্ট করে বলেছিলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান।
তাই শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রশ্ন রাখেন- রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কী উদ্যোগ নেওয়া হবে। জবাবে জাতিসংঘ প্রধান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত কঠিন হবে, তা স্পষ্ট।’
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান আর্মিকেও আলোচনায় যুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
‘আরাকান আর্মিও এখন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমি মনে করি তাদের সাথেও প্রয়োজনীয় সংলাপ হওয়া উচিত। কারণ আমরা জানি যে অতীতে রাখাইন এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক সহজ ছিল না।’ বলেন তিনি।
করিডোর দেবে বাংলাদেশ?
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ করিডোর হিসেবে ব্যবহার হতে পারে- এমন একটি আলোচনা ছিল গত কয়েকদিন।
জাতিসংঘ মহাসচিব সফরের আগের দিন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। তবে তিনিও এ নিয়ে কোন উত্তর দেন নি।
তাই শনিবারের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রাখাইনে মানবিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশকে চ্যানেল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে কী না সেটি জানতে চান সাংবাদিকরা।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অবশ্য এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি। তবে বিষয়টি একেবারে উড়িয়েও দেননি জাতিসংঘ প্রধান।
গুতেরেস এই প্রশ্নে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই, যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন।’ এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘ কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেবে কি-না তাও প্রশ্ন ছিল।
জবাবে গুতেরেস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ও চাপ প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে সহিংসতা বন্ধ করে একটি সংলাপ প্রক্রিয়া গড়ে তোলা যায়। এই সংলাপের মাধ্যমে মিয়ানমারে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধান আসতে হবে যা স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে।’
ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ সফর
যৌথ এই সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই সফরে জাতিসংঘ মহাসচিব উপলব্ধি করেছেন যে রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে কতটা মরিয়া। তারা তাদের পরিচয়, অধিকার ও সম্মানজনক জীবন উপভোগ করতে চায়।’
এমন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কী?
এই প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এই সমস্যার সমাধান সীমান্তের অন্য পাড়ে রয়েছে। ওখানে সবগুলো কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। কারণ মিয়ানমারে এখন ভিন্ন একটি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের সব পক্ষকেই রাজি করাতে হবে যাতে রোহিঙ্গার নিশ্চিন্তে রাখাইনে ফিরে যেতে পারে।’
সংস্কার ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে জাতিসংঘ মহাসচিব সমর্থন জানিয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘সংস্কার বিষয়ে যে যে সহযোগিতা প্রয়োজন তার সবকিছুই করবেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার জন্য এবং বাংলাদেশ ও তার জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।’
জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশবিরোধী বিভ্রান্তিকর প্রচার ও মিথ্যা তথ্য নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলেও জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তার কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, ভারতে আশ্রয় নেয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে কি না।
তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, জাতিসংঘের সাথে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক দলগুলো কী বলছে?
এদিন বিকেল তিনটায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল আলোচনা করেন সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব।
প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
পরে বৈঠক শেষে বিএনপি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয়গুলো, সংস্কারগুলো করে ফেলা। তারপর দ্রুত নির্বাচন করা। এরপর একটি সংসদের মাধ্যমে বাড়তি সংস্কারগুলো করা। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটাই আমরা বলেছি।’
নির্বাচন নিয়ে কোনো টাইম ফ্রেমের কথা বলেছেন কি না জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের কোনো টাইম ফ্রেমের কথা বলার প্রয়োজন নেই। সংস্কার আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা সংস্কার কমিশনগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলছি, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। তারা যা চাচ্ছে আমরা সব দিয়ে দিচ্ছি। ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে একটা বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবকে আমরা আমাদের টাইম ফ্রেমটা দিতে যাবো কেন?"
এদিকে আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন ও জাতীয় ঐক্যে গুরুত্ব দিয়েছে জামায়াত ইসলামী।
বৈঠক শেষে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সংস্কারের ব্যাপারে কথা বলেছি। একটা ফেয়ার (নিরপেক্ষ) নির্বাচনের বিষয়ে বলেছি, টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে কথা বলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের অধিকাংশ বক্তব্য সমর্থন করে বলেছেন সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তিনি আশাবাদী।’
এই বৈঠকে যোগ দেয় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বৈঠক শেষে বলেছেন, ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষে আমাদের সংস্কার বিষয়ে যে অবস্থান, আমরা মনে করি, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে, বিচার ও সংস্কার অন্যতম কমিটমেন্ট জনগণের কাছে।’
সংবিধান সংস্কার নিয়ে এনসিপির অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার বিষয়ে আমাদের যে অবস্থান যে গণপরিষদের মাধ্যমেই সংস্কার করতে হবে, অন্যথায় সংস্কার টেকসই হবে না।’
তিনি জানান, জুলাই-অগাস্টের গণহত্যার বিচার ও সংস্কার বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের এই দলটি। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমআর