সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ের আহতরা দিনভর বিক্ষোভ করে রোববার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে যান। কিন্তু সরকারের কোনো উপদেষ্টা তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। শেষ পর্যন্ত গভীর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তাদের বুঝিয়ে হাসপাতালে ফেরত পাঠান।
প্রশ্ন উঠেছে, যাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এই সরকার, তাদের সুচিকিৎসার দাবি আদায়ের জন্য কেন আন্দোলন করতে হবে? সরকার কি তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে আন্তরিক না? নাকি যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো যথেষ্ট না? প্রধান উপদেষ্টা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের যে ১০০ কোটি টাকা দিলেন, সেই টাকা তাহলে কোথায়?
বিজ্ঞাপন
আন্দোলনের সময় ঢাকার মিরপুরে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন কবির হোসেন। জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘চোখে এখনো স্প্লিন্টার রয়েছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালেই ছিলাম। তবে এখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাসায় গেলেই চোখে জ্বালা-পোড়া বেড়ে যায়। এক চোখে ঠিকমতো দেখতে পারি না। হাসপাতালে এলে একটা ড্রপ ও ব্যথার ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। আমার সুচিকিৎসা দরকার। সরকার অনেকেরই উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আমার কী অপরাধ? আমি কেন উন্নত চিকিৎসা পাবো না?’
সর্বশেষ গত শনিবার রাতে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল)-এ ভর্তি থাকা জুলাই আন্দোলনে আহতরা রাস্তায় নেমে আসেন। পরদিন, অর্থাৎ রোববার সকাল থেকে আবারও রাস্তায় নামেন। শ্যামলীতে শিশু মেলার সামনে মিরপুর সড়ক অবরোধ করে রাখেন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এরপর তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে আসেন। সেখান থেকেই হাসনাত আবদুল্লাহ তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠান। এর আগেও গত ১৩ নভেম্বর হাসপাতালের সামনে রাস্তায় নেমেছিলেন তারা। গভীর রাতে সরকারের চারজন উপদষ্টো সেখানে হাজির হয়ে সুচিকিৎসার আশ্বাস দিলে সেবার তারা হাসপাতালে ফেরেন।
জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে অনেকে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে রাজধানীর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৭৮ জন। আন্দোলনে গুলিতে চোখ নষ্ট হয়েছে চার শতাধিক মানুষের। এর মধ্যে দুই চোখ হারিয়েছেন অনেকে। আর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯৮ জন। তাদের মধ্যে ২১ জনের হাত-পা কাটা গেছে। কারো গুলিবিদ্ধ স্থানে টিস্যু প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে। তাদের অনেকেরই বিদেশে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন।
বিজ্ঞাপন
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার একটুও অবহেলা করেনি। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ডসহ পাঁচটি দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের টিম বাংলাদেশে এসে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা দেখেছে। আমরা কোনো ত্রুটি করেছি বা আরেও ভালো কিছু করা যেতে- এমন কোনো পরামর্শ তারা দেননি। তার অর্থ আমরা সঠিকভাবেই চিকিৎসা দিচ্ছি। এ পর্যন্ত আমরা ৩০ জনকে বিদেশে পাঠিয়েছি উন্নত চিকিৎসার জন্য। আমাদের কাছে যাদের বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ আসছে, তাদেরই পাঠানো হচ্ছে। এখানে টাকা কোনো বিষয় না। এই মুহুর্তে অ্যামেরিকার একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে রয়েছে। সর্বশেষ সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ দল ২৭৮ জনকে পরীক্ষা করে আরো ৭ জনকে বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করেছে। আমরা তাদের পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছি। ফলে যখন যে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, সেটাই কিন্তু সরকার পালন করছে।’
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন চাঁদপুরের আবীর আহমেদ শরীফ। মিরপুর-২ নম্বরে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্তের উপর এই সরকার প্রতিষ্ঠিত। অথচ আমার চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তারা কিছুই করছে না। এখন থেকে অন্তত তিন মাস আগে যদি সরকার আমাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতো, তাহলে আমরা একটা চোখ যে নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা হতো না। এখন যদি আমাকে বিদেশে পাঠায় তাতেও আর কাজ হবে না। কারণ, মরা গাছে কখনো ফুল ফোটে না। আমার চোখের টিস্যু শুকিয়ে গেছে। এটা শুধু আমি না, এমন বহু ছেলের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে সরকারের অবহেলার কারণে। অথচ তারা ক্ষমতায় বসে দাদাগিরি ফলাচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে, মিথ্যা কথা বলছে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নামে লুটপাট হচ্ছে। জুলাই আন্দোলনে ২২ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এদের ৫ হাজার জনও এক লাখ টাকা করে পাননি। তাহলে সরকার কাদের টাকা দিলো?’
আহতরা যা বলছেন তা ঠিক কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তাদের দাবির সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি। এখন আমরা চাইলেই তো কাউকে বিদেশে পাঠাতে পারি না। এখানে একটা প্রক্রিয়া আছে। বিশেষজ্ঞ টিম, যাদের বিদেশে পাঠাতে বলছে, আমরা তাদের পাঠাচ্ছি। এখন ধরেন, যারা হাসপাতালে আছেন, তাদের অনেকেই বাড়ি যেতে পারেন। বাড়িতে থাকলেও যে চিকিৎসা, হাসপাতালেও একই চিকিৎসা। আবার দেশে যে চিকিৎসা তিনি পাচ্ছেন, বিদেশে পাঠালেও একই চিকিৎসা হবে। যার পা ভেঙেছে, সেটা ঠিক হতে তো সময় লাগবে৷ আসলে যারা আহত আছেন তারা ৫-৬ মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এতে ওনাদের যে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে, সেটি প্রশমনে আমাদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট ব্যবস্থা আমরা নিতে পারিনি। এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।’
আহতদের দাবির মধ্যে আছে '২৪-এর যোদ্ধাদের মধ্যে আহত এবং শহীদদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ বিচার, ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের সরকারের বিভিন্ন পদ থেকে অপসারণপূর্বক গ্রেফতার, আহতদের ক্যাটাগরি সঠিকভাবে প্রণয়ন, আহতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে বাস্তবায়ন, আহতদের চিকিৎসার সর্বোচ্চ সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা, আহত এবং শহীদদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননাসহ প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও আহতদের আর্থিক অনুদানের অঙ্ক বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টা সুসংহত করা।
গত ১৪ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আহতদের দাবি-দাওয়া নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বলা হয়, দ্রুত সময়ের মধ্যে জুলাই আন্দোলনে আহতদের উন্নত চিকিৎসা, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানে ব্যবস্থা করা হবে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, অথচ তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো দাবি পূরণ করা হয়নি। পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মো. দুলাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তিন মাস আগে সরকারের পক্ষ থেকে সুচিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এখন পর্যন্ত কোনো ভালো চিকিৎসা আমি পাইনি। এমনকি সরকারের কেউ এখন আমাদের খোঁজখবরও আর নেয় না।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ১৪ হাজারেরও বেশি আহত আবেদন করেছেন। এর মধ্যে আহত ১২ হাজার ৯০০ জনের নাম যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই তালিকা চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ জানুয়ারি নিহতদের তালিকার গেজেট প্রকাশ হলেও আহতদের তালিকার কোনো গেজেট এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তালিকায় এবার নামের সঙ্গে অন্য প্রয়োজনীয় তথ্যসহ ছবি যুক্ত করার কাজ চলছে।
আহতদের পুনর্বাসনের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বলেছেন, ‘গুরুতর আহতদের হাসপাতালে রেখে শারীরিক পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপি দেওয়া হবে। এছাড়া জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে শহীদ পরিবারের নিকটতম কোনো সদস্যকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। শহীদ পরিবারের কাছের সদস্যদের চাকরির ব্যবস্থাও করা হবে। আহতদের মধ্যে যারা চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্ধত্ববরণ করেছেন, কিংবা আংশিক দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, তাদের পছন্দ অনুযায়ী, সামর্থ্য ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন বা অন্ধ হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, তাদের আজীবন ভাতা দেওয়া হবে। প্রয়োজনে পরিবারের একজনকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সহায়তা করা হবে। বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।’
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আবীর আহমেদ শরীফ বলেন, ‘এই কথা তো শুরুর দিন থেকে শুনে আসছি। কবে বাস্তবায়ন করবে? বাস্তবায়নের তো কোন উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। এই কাজগুলো হলেও তো আহতরা একটু শান্তি পেত। আমরা বলছি, সরকার যেটা বলছে, সেই কাজটাই অন্তত করে দেখাক।’ সূত্র: ডয়চে ভেলে
জেবি