শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

রক্তের পথে বিপ্লবী বছরের বিদায়, ইতিহাসের বাঁক বদল

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১৪ এএম

শেয়ার করুন:

রক্তের পথে বিপ্লবী বছরের বিদায়, ইতিহাসের বাঁক বদল

২০২৪—দেশের ইতিহাসে এক বিপ্লবী বছর হিসেবে চিহ্নিত হবে, যা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বছরের শুরু থেকেই যেন সূচিত হয়েছিল এক রাজনৈতিক সংঘাতের যাত্রা, যার পরিণতি ছিল অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী এবং প্রতিরোধের এক যুগান্তকারী ঘটনা। প্রথমে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু হওয়া যাত্রায় একে একে ঘটতে থাকে সেই সব ঘটনা, যা বাংলাদেশকে এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্তে নিয়ে যায়। ২০২৪ সালে ঘটে বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান, এবং এক অজস্র প্রাণের বিনিময়ে সরকারের পতন। বছরের পর বছর ক্ষমতার আড়ালে থাকা ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন নিশ্চিত করে গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থার নবায়ন। 

যত সময় গেছে, এ বছরের ঘটনা যেন প্রতিটি মানুষকে এক নতুন রূপে দেখিয়েছে। বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত ডামি নির্বাচন ছিল সরকারের একতরফা শাসনের সর্বশেষ পদক্ষেপ। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন ছিল এক সুস্পষ্ট প্রহসন, যেখানে বিএনপি, জামায়াতসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো উপস্থিতি ছিল না। প্রতিপক্ষহীন নির্বাচনের ফলে কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নেয় আওয়ামী লীগ, এবং তাদের প্রার্থীরা হয় ‘ডামি’ বা ‘প্রতীক’। শেষ পর্যন্ত, একতরফা এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু প্রশ্ন, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ছিল কি না, তাতে এখনও একাধিক বিতর্ক রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


গণআন্দোলনের সূচনা: ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত বিপ্লব
যত দিন গড়িয়েছে, গত ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল হওয়ার পর দেশে কোটা সংস্কারের নতুন আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু এই আন্দোলনের এক অন্যতম মুহূর্ত ছিল ১৪ জুলাই, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিতর্কিত মন্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও কি কোটা পাবেন না? তাহলে রাজাকারের নাতি-পুতিরা কীভাবে পাবেন? এই মন্তব্যে দেশের ছাত্রসমাজ, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে আন্দোলনে অংশ নেয়।

ছাত্রলীগের হামলা এবং পুলিশের অত্যাচারে আন্দোলন নতুন দিক নেয়। ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা আর নিরব থাকবে না। একসময় আন্দোলনটি শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সারাদেশে সাধারণ জনগণও এতে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

এরপর ১৬ জুলাই, রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্র নেতা আবু সাঈদ। তিনি যখন পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সেই মুহূর্তের ছবি মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়, যা আন্দোলনের আগুনে আরও ঘি ঢেলে দেয়। ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের দাবি ছিল, সরকার যেন কোটা সংস্কারের দাবিতে তাদের আঘাত না করে, বরং সমাধান বের করে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সহায়তায় আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালানো হয়। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয় শতশত আন্দোলনকারী। বিভিন্ন শহরে, বিশেষত ঢাকায়, চলতে থাকে তীব্র সহিংসতা, পুলিশ ছররা গুলি, রাবার বুলেট এবং লাইভ বুলেট ব্যবহার করতে থাকে।

সরকারের পতন: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান
৫ আগস্ট—দেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ছাত্র-জনতার মিছিল সেদিন ঢাকার পথে নামে এবং প্রায় একযোগে, সারাদেশে জনগণের আন্দোলন চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এতদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সেদিন তাদের শেষ মুহূর্তে চলে যায়। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য জনগণ একত্রিত হয় এবং ৪৫ মিনিটের মধ্যে ক্ষমতা থেকে তাকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। চরম গণরোষের মুখে তিনি পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।


বিজ্ঞাপন


অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: নতুন বাংলাদেশের খোঁজ
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ—এখন দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে নতুন করে সংস্কার করার প্রয়োজন। অবিলম্বে শুরু হয় নির্বাচনের জন্য পদ্ধতি ঠিক করা, নতুন কমিশন গঠন এবং বিভিন্ন কমিশনের মাধ্যমে জাতির সামনে সম্ভাবনার নতুন পথ উন্মুক্ত করা। এই সরকারের অনেকগুলো সংস্কার পরিকল্পনা ছিল। প্রায় ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়, যার মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এই সরকারের কাছে অপেক্ষা ছিল জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। তবে সংস্কারের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছিল।

সংস্কারের পথ: রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রায় ৯০ দিনের মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। দলগুলো একদিকে নির্বাচন এবং অপরদিকে সংস্কারের প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সরকার যেমন নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তেমনই এই সংস্কারের উদ্যোগে জনগণের মধ্যে একধরনের সংশয়ও তৈরি হয়েছে। বিশেষত, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা এখন অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নতুন বছরের দিকে: বাংলাদেশ কি বদলে যাবে?
২০২৪ সাল ছিল দেশের রাজনীতির জন্য একটি বাঁক বদলানো বছর, তবে সামনে যেটি অপেক্ষা করছে, তা হলো দেশের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি, জনগণের আশা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও বেশি আলোচনার প্রয়োজন। কোটা আন্দোলন, ছাত্র-জনতার রক্তের বিপ্লব, সরকারের পতন, এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা—এই সবকিছুই দেশের ভবিষ্যতকে নির্ধারণ করবে। নতুন বছরটি দেশের জন্য আরেকটি নতুন দিগন্তের সূচনা করতে যাচ্ছে, যেখানে জনগণের শক্তির নতুন এক দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর