শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগ, শঙ্কা নিয়ে বসবাস পুরান ঢাকায়

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩ জুন ২০২২, ০৮:১৯ এএম

শেয়ার করুন:

নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগ, শঙ্কা নিয়ে বসবাস পুরান ঢাকায়

নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগ। ২০১০ সালের ৩ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩ জুন। এরমধ্যে কেটে গেছে ১২টি বছর। পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ১২৪ জন মানুষ মারা যান। সেই ঘটনার ১২ বছরেও রাসায়নিক কেমিক্যালের গুদাম স্থানান্তর না হওয়াতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাতো আছেই। রাসায়নিকের গুদামে রক্ষিত দাহ্য পদার্থের কারণেই পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়।

২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাবকাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত নয়টার দিকে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার সময় ছয়তলা বাড়িটির নিচতলায় দুই বোন রুনা আর রত্না ও পাশের বাড়িতে আসমা নামে এক মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। রান্নার জায়গার পাশেই ছিল কেমিক্যালের গুদাম। প্রচণ্ড তাপে গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিকের ড্রাম গলে যায়। ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের এগারো জনের মৃত্যু হয়। আর সামনের ৫৫ নম্বর বাড়ির ৬ জন ও বিয়ের বাড়ি লাগোয়া বাড়ির আর ছয়জনের মৃত্যু হয়। পরে তিন কন্যাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃস্নেহে গণভবনে বিয়ের আয়োজন করেন।


বিজ্ঞাপন


২০১০ সালে ৩ জুন ঘটে যাওয়া ঘটনা দেশের ইতিহাসে নিমতলী ট্রাজেডির এক যুগ আজ। বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবছর দিনটিকে ‘নিমতলী ট্র্যাজেডি’ হিসেবে স্মরণ করে। এ ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের দোকান ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার জোরালো দাবি ওঠে। এ নিয়ে সময় বেঁধে দিয়েছিল সরকারও। তবে আজও তা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

রাজধানী থেকে রাসায়নিকের গুদাম-কারখানা সরিয়ে নিতে হয় দুটি কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটি কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে জায়গা ঠিক করার সুপারিশসহ উচ্চ মাত্রার বিপজ্জনক ৫ শতাধিক রাসায়নিকের তালিকা করে প্রতিবেদন দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ে। বাস্তবায়ন হয়নি বলে স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন সামনে আরও বড় দুর্ঘটনা অপেক্ষা করছে। প্রতিনিয়ত আতঙ্ক নিয়েই বসবাস করছেন নিমতলী, নবাবকাটরার বাসিন্দারা। কেননা এখনো অলিগলিতে কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে।

nimtoli

নিমতলীর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় বড় আগুনে প্রাণহানির সংখ্যা ৭১। এ দুটি ভয়াবহ দুর্ঘটনারই উৎস রাসায়নিকের গুদাম। এর মধ্যে আরও অন্তত অর্ধশত আগুনের ঘটনার তথ্য এলাকাবাসীর জানা। তবু সেই রাসায়নিকের সঙ্গেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয়রা। আর কতজন লাশ হলে রাষ্ট্র পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম সরিয়ে নেবে—প্রশ্ন রেখে তাদের একজন বলেন, পুরান ঢাকাকে আর মৃত্যুপুরী না বানাতে চাইলে এখনো সময় আছে রাসায়নিক গুদাম সরানোর।


বিজ্ঞাপন


২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাবকাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত নয়টায় কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। এরপর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকাগুলো থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করে। ওই সময় সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে ১৯২৪ জন ব্যবসায়ীর তালিকা করে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির কাছে হস্তান্তরও করে।

পরে ওই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থায়ীভাবে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের তুলসীখালীতে কেমিক্যাল পার্ক নির্মাণ করার দায়িত্ব দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিককে। এ সময় আপৎকালীন সুরক্ষা ব্যবস্থা করার জন্য পোস্তগোলায় একটি কেমিক্যাল গোডাউন নির্মাণ করার জন্য বিসিআইসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে বিসিআইসি এখনো ওই গোডাউন নির্মাণ করতে না পারায় আজও পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম সরানো সম্ভব হয়নি।

নিমতলীতে ভয়াবহ রাসায়নিকের আগুনে পরিবারের ১১ সদস্যকে হারান মো. গোলাম এলাহি জানান, ভয়াবহ সেই আগুনে আমার ভাই দিদার ও ফারুক পারিববারিক কাজে বাড়ির বাইরে থাকায় আমরা বেঁচে আছি। তবে দেখেন, আমাদের বৃদ্ধা মাসহ স্ত্রী-সন্তানরা মারা যান। ওই আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া আমার দুই যমজ ছেলের নাম ছিল ইমতিয়াজ গোলজার ও ইসতিয়াক গোলজার। ফের আমার পিঠাপিঠি দুই ছেলে হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আবু তালেব, হোসেন মিয়া, খালেক ভূইয়া জানান, এখনো নবাবকাটরা, আগামসি লেন, নাজিরাবাজার, মিটফোর্ড, কায়েতটুলীসহ আশপাশের অনেক বাড়িতে গোপনে কেমিক্যালের কার্যক্রম চলে। গুদাম আছে। আর এসব কারণেই তারা শঙ্কার কথা বলেন।

তবে গোপনে কেমিক্যাল গুদাম হিসাবে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে, এমন বাড়ির মালিকের সংখ্যাও কমে গেছে অনেক উল্লেখ করে ডিএসসিসির (ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি আব্দুল আওয়াল জানিয়েছেন, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের অধিকাংশ গুদাম সরে গেছে। বিশেষ করে নবাবকাটরায় কেমিক্যালের গুদামের পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কম। সবার মধ্যে সচেতনতা আসছে আর সিটি করপোরেশন ও অন্য সংস্থার তৎপরতায় এখন আর কোনো বাড়িওয়ালা কেমিক্যালের গুদাম হিসাবে বাড়ি ভাড়া দেয় না। 

নিমতলী ট্র্যাজেডিতে নিহত সাত বছর বয়সি বৈশাখের পিতা মামুন মিয়া বলেন, ওইদিন ঘটনার সময় আমার ছেলে দোকানে ঘুমিয়েছিল। গরম কেমিক্যালে পুড়ে আমার ছেলে মারা গেছে। আমি তখন দোকানের বাইরে ছিলাম। দৌড়ে দোকানের কাছে গিয়ে ছটফট করতে করতে আমার ছেলেকে মরতে দেখেছি। নবাবকাটরা এলাকায় কেমিক্যালের গুদাম কমেছে এবং পুরোপুরি সরানো হয়নি দাবি করেন মামুন মিয়া।

একই ঘটনায় স্বজন হারানো শাহনাজ বেগম বলেন, নিমতলীর আগুনে আমার বড় ভাই, বোন, বোনের ছেলে—সবাই মারা গেছে। এখনো এলাকায় অনেকেই ব্যবসা করছেন। প্রকাশ্যে না গোপনে তা বলতে পারবো না, আফসোস হয়। যারা চলে গেছে তাদের স্মৃতি মনে হলে এখনো ভুলতে পারি না।

nimtoli

আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যালের গুদাম সরে যাবে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, নতুন করে পুরান ঢাকায় গুদাম স্থাপন করে কাউকে কেমিক্যাল ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কেমিক্যালের গুদাম শনাক্ত করে তা সরানোর কাজ চলছে। এছাড়া শ্যামপুর ও মুন্সীগঞ্জে দ্রুত অবকাঠামোর উন্নয়ন করা সম্ভব হলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই কেমিক্যালের গুদাম ও প্লাস্টিক শিল্প প্রতিষ্ঠান সরে যাবে। পাশাপাশি কেমিক্যাল গুদামে আগুন লাগলে তার ভয়াবহ পরিণতি এবং ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে।

২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনের পর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে রাসায়নিক পল্লি গড়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছিল, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০২ কোটি টাকা। জমির পরিমাণ ছিল ৫০ একর। পরে ২০১৯ সালে মুন্সিগঞ্জের ৩১০ একর জমিতে রাসায়নিক শিল্পপল্লি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও দোকান সরানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই মন্ত্রণালয় মুন্সিগঞ্জে ৩১০ একর জমিতে রাসায়নিক শিল্পপার্ক করছে এবং টঙ্গী ও শ্যামপুরে অস্থায়ী দুইটা গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। 

সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে নির্মিত কেমিক্যাল ভিলেজের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এখানে নিরাপদ পরিবেশ দিতে হবে। যেহেতু একটি গিঞ্জি এলাকা আবার আগুন লাগলে অনেক স্থানে প্রবেশ করা কষ্টসাধ্য। তাই জনসচেতনতা থেকে শুরু করে পুরান ঢাকাকে তার বসবাসযোগ্যতায় ফিরিয়ে আনার জন্য পুনর্গঠন করতে হবে। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দ্রুত বিশেষ শিল্পায়িত অঞ্চলে পুনর্বাসন করার কথা বলেন নগর পরিকল্পাবিদরা।

ডব্লিউএইচ/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর