তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন জরুরি বলে মনে করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন এবং সরকারের আমলাদের একাংশ। একই সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও তামাক বিরোধী প্রচারণায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে সমাজের সচেতন নাগরিক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক, এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণ এবং তামাকপণ্যের আইন সংশোধনের দাবিতে একটি নীতিনির্ধারণী আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেখ মোমেনা মনি, অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বস্বাস্থ্য অনুবিভাগ), স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ, নির্বাহী পরিচালক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন, চেয়ার, গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ভাক্সিন অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ (গ্যাভী); মো. মহসীন, যুগ্মসচিব (বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অধিশাখা), স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল, জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট), পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ; ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী, যুগ্মসচিব (জনস্বাস্থ্য অধিশাখা), স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
সভায় বক্তৃতাকালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বস্বাস্থ্য অনুবিভাগ) শেখ মোমেনা মনি বলেন, তামাকপণ্যের আইন শক্তিশালী করার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে তামাকপণ্যের প্রচারণা বন্ধ করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি এবং প্রচারণা বন্ধে একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করার জন্য। আমরা স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদেরকেও তামাক বিরোধী প্রচারণায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, তামাক চাষে যারা নিয়োজিত আছে আমরা তাদেরকে সাথে নিয়েও কাজ করার চেষ্টা করছি যাতে করে তারা তামাক চাষ বন্ধ করে নতুনভাবে অন্য উপায়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।
অতিরিক্ত সচিব বলেন, আমি মনে করি তামাকপণ্যের ব্যবহার বন্ধ করতে আমরা ডিজিটাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পারি। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর, সুস্থ ও সবুজ বাংলাদেশ গড়ার কোন বিকল্প নেই।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ তার বক্তব্যে বলেন, তামাক সেবন একটি জাতীয় স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তামাকজাত দ্রব্য যেমন: সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল ইত্যাদি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর মধ্যে থাকা নিকোটিনসহ ৪০০০-এরও অধিক রাসায়নিক পদার্থ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতিসাধন করে এবং নানাবিধ জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি আরও বলেন, তামাক ব্যবহারের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ এবং অন্যান্য ধরনের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ১৯ শতাংশ বেড়ে যায়। এ কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর দৃষ্টি দিতে বাধ্য করার কোন বিকল্প নেই।
সরকারের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মহসীন বলেন, তামাকপণ্য উৎপাদনের উপর কঠোর আইন প্রয়োগ করার এখনই উত্তম সময়। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এছাড়া বেসরকারি সংস্থা এবং মিডিয়ার সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করলে এর চাহিদা কমবে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ এবং তরুণদের মধ্যে তামাক সেবন হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ সরকারকে একটি ক্রমবর্ধমান কর কাঠামো নীতি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে করের হারও বৃদ্ধি পাবে।
জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, তামাকপণ্যের উপর কঠোর আইন পাশ না করার জন্য বাংলাদেশের অনেক তামাক কোম্পানি প্রচুর অর্থ খরচ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারকে এই দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে প্রায় পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে।
তিনি আরও বলেন, কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তামাকজাত দ্রব্যের বহুল ব্যবহার হৃদরোগ, ক্যান্সার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক প্রতিরোধযোগ্য রোগ এবং মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তামাকের এসব ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে শক্তিশালী করার কোন বিকল্প নেই।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডা. ইফতেখার মুহসিন প্রোজেক্ট কো-অরডিনেটর, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন, গণমাধ্যমকর্মী, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ।
এই সভার মধ্যে দিয়ে তামাক বিরোধী আইন শক্তিশালীকরণ এবং তামাকজাত পণ্যের আইন সংশোধনের জোর দাবি জানানো হয় এবং তামাক বিরোধী কার্যক্রমকে সুদৃঢ় করতে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয়।
কারই/এফএ

