সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

বিচারহীন হত্যা, আ.লীগের ১৫ বছর রাজনৈতিক প্রতিশোধের কালো অধ্যায়

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ পিএম

শেয়ার করুন:

বিচারহীন হত্যা, আ.লীগের ১৫ বছর রাজনৈতিক প্রতিশোধের কালো অধ্যায়

২০১৬ সালের ১০ জুলাই— পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অলিউল্লাহ মোল্লা। সেদিন বিকেলে পুলিশ অলিউল্লাহকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও। পরদিন সকালে অলিউল্লাহর মৃত্যুর খবর পায় পরিবার।

পুলিশের দাবি— ঘটনার দিন রাতে মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় অলিউল্লাহ পুলিশকে থামানোর সংকেত উপেক্ষা করে বোমা ও গুলি ছোড়েন, ফলে পুলিশের পাল্টা গুলিতে তার মৃত্যু ঘটে। পরে পুলিশের নথিতে এই ঘটনাকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং অলিউল্লাহকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।


বিজ্ঞাপন


শুধু অলিউল্লাহই নন, হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে এমন অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন, যা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যে উঠে এসেছে। আসক এই পরিসংখ্যান সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে সংগ্রহ করেছে। তথ্য বলছে— বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডে নিহতদের নামের পাশে ২৩ ধরনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীও রয়েছেন। তবে বেশির ভাগ নামের পাশে ‘সন্ত্রাসী’, ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘বন্দুকধারী’ বা ‘অস্ত্রধারী’, ‘মাদক কারবারি’, ‘জলদস্যু’, ‘বনদস্যু’, ‘ডাকাত’, ‘ছিনকাইকারী’, ‘মামলার আসামি’, ‘চরমপন্থী’— ইত্যাদি পরিচয় দেওয়া হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক কর্মীকেও এসব পরিচয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন বলছে— প্রতিটি ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় একই ধরনের বর্ণনা দেওয়া হয়। যদিও হাসিনা সরকার এসব হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করে এসেছে বরাবরের মতোই। পুলিশ বিশেষ শাখা (এসবি) ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ‘ক্রসফায়ার’ সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ করেছে, যেখানে দেখা যায় এই সময়ে ১ হাজার ২৯৩ জন ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫১টি ঘটনায় পুলিশ ও ২৯৩টিতে র‌্যাব যুক্ত ছিল। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যুক্ত ছিল ৪৬টি ঘটনায়। ১০টি ঘটনায় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ইত্যাদি বাহিনী যৌথভাবে অংশ নেয়। বাকি ঘটনাগুলোয় কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য বাহিনী যুক্ত ছিল। একটি ঘটনায় কোনো বাহিনীর নাম উল্লেখ করা হয়নি।

পুলিশি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে, যা আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিভাগে, এখানে নিহত হন ২৯১ জন। এরপরেই রয়েছে খুলনা, সেখানে নিহত ২৬০ জন। এর বাইরে রাজশাহী বিভাগে ১১৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৮ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৭ জনকে বিচার ছাড়াই গুলি করে হত্যা করা হয়। 


বিজ্ঞাপন


আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে ৬৪ জেলার প্রতিটিতেই কোনো না কোনো সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ারের ঘটনা কক্সবাজারে। সাত বছরে (২০১৫–২১) এই জেলায় ২২৬ জন নিহত হন পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ক্রসফায়ারে। জেলা হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ারে ঘটনা ঢাকায়; এখানে নিহত ১৫১ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রামে ৭০ জন। সবচেয়ে কম ঘটনা শেরপুর, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে। এসব জেলায় সাত বছরে একজন করে নিহত হন।

পুলিশের বিশেষ শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ১২৪ জন, ২০১৬ সালে ১৬৩ জন, ২০১৭ সালে ১৬৪ জন, ২০২০ সালে ১৪৭ জন ও ২০২১ সালে ৩০ জন পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। 

সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রসফায়ারের সাজানো বর্ণনা দিয়ে মামলা করা হয়, যেখানে নিহত ব্যক্তির সহযোগীদেরও আসামি করা হয়। বেশিরভাগ পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না এবং যারা চেষ্টা করেন, তারা হয়রানি ও হুমকির শিকার হন।

অলিউল্লাহ মোল্লার স্ত্রী সালিমা গত ২৮ অক্টোবর বলেন, “আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। এরপর থেকে আমাদের মামলা না করতে হুমকি দেওয়া হয়।” তিনি ২০১৬ সালের ঘটনায় সম্প্রতি সাতক্ষীরার আদালতে মামলা করেছেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ক্রসফায়ারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা এর একটি বড় নজির। র‌্যাবের কিছু সদস্য স্থানীয় নেতার সঙ্গে যোগসাজশে এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ১ হাজার ২৯৩ জনের মধ্যে ৪৭৭ জনকে ‘মাদক কারবারি’, ৩০০ জনকে ‘ডাকাত’ এবং ১৪২ জনকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

২০১৮ সালে নির্বাচন বছরে ক্রসফায়ারের সংখ্যা অতীতের সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়। এই বছরে ৩০০টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ৩৫৮ জন নিহত হন। নির্বাচনের আগে এবং পরে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা বাড়ে, যা রাজনৈতিক দমন-নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাব এবং এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে ক্রসফায়ারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

বর্তমান পুলিশ প্রশাসন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কাজ করছে। পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান বাহারুল আলম বলেন, “একসময় কাউকে গুলি করার কথা ভাবলেই আমাদের মধ্যে কাঁপন ধরে যেত। কিন্তু বর্তমানে ক্রসফায়ারের নামে হত্যার সংস্কৃতি সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তার লাভ করেছে।”

এভাবে ক্রসফায়ার, গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। তার মতে— ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের বেপরোয়া গুলির পেছনে গত ২০ বছরের গুলি করার অভ্যস্ততা কাজ করেছে।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর