🔹 সাধারণ রিকশার ব্রেক ব্যবহার হয় ব্যাটারিচালিত রিকশায়
🔹 পুরো ব্রেক কষলেও বহুদূর গিয়ে থামে
🔹 গতির তুলনায় ব্রেক একেবারেই মানহীন
🔹 বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাটারির রিকশা ‘ব্রেক ছাড়া’ গাড়ি
সড়কে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যান মোটরসাইকেল। গতিশীল এই বাহনে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেশি। তবে দুই চাকার বাহনটিতে ব্রেক দেওয়া হয় বেশ শক্তিশালী। লাখ টাকার এই বাহনে ব্রেক থাকে দুই চাকাতেই। আর সেক্ষেত্রে সবচেয়ে নিম্নমানের ব্রেকের পেছনেও খরচ হয় আটশো টাকা। মোটামুটি মানের ব্রেকের পেছনে খরচ দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
বিজ্ঞাপন
দেশের বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির দামি মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। পাশাপাশি এক লাখ টাকা বা তার কমেও পাওয়া যাচ্ছে মোটরসাইকেল। এই বাহনের কাছাকাছি দামের আরেক বাহন ব্যাটারিচালিত রিকশা। সাধারণ রিকশায় মোটর লাগিয়ে তার গতি বাড়ানো হয়েছে। তবে এর ব্রেক পদ্ধতি আছে সাধারণ রিকশার মতোই।
নগরীর বিভিন্ন এলাকার রিকশাচালকরা জানিয়েছেন, ব্যাটারিচালিত একেকটি রিকশা বানাতে খরচ হয় ৮৬ থেকে ৯২ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অপরিকল্পিত এই বাহনের গতি ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। তবে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার গতিতে নগর দাপিয়ে বেড়ায় এই বাহন। সেই গতিকে নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্রেক পদ্ধতি খুবই নগন্য।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অবৈধ এই পরিবহন তৈরি হচ্ছে ঘরে ঘরে। প্রতিদিন কি পরিমাণ ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরি হয়, তার হিসেব নেই কারও কাছে।
রিকশা তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ মালিক মো. মিজানুর রহমান ঢাকা মেইলকে জানান, প্রথমে রিকশার মূল আকার তৈরি করা হয়। লোহার পাত দিয়ে ১৬ হাজার টাকার বিনিময়ে তৈরি হয় এই আকার। যা তৈরি করেন সাধারণ লোহার ওয়ার্কশপের কারিগররা। এরপর রিকশার চাকা, ব্যাটারি থেকে শুরু করে সবকিছু যুক্ত করা হয়।
প্রায় লাখ টাকা মূল্যের এই রিকশার শুধু সামনের চাকায় ব্রেক লাগানো হয়। পেছনের দুই চাকায় কোনো ব্রেক নেই৷ ফলে গতিতে থাকা বাহনকে চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে থামানো সম্ভব না। যা স্বীকার করেছেন খোদ চালকরাই।
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক মনা মিয়া ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, মেশিনের গাড়ি, জোরে তো চলবোই।
পুরো গতিতে থাকা অবস্থায় এই রিকশায় ব্রেক কষলে থামতে কতক্ষণ সময় লাগে? এমন প্রশ্নের জবাবে এই রিকশা চালক বলেন, ‘ব্রেক করলে ধরে। কিন্তু স্প্রিডে থাকে তো। কিছুদূর ছেচরে যায়।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে উঠে এসেছে ‘কিছুদূর ছেচরে যাওয়া’র দূরত্ব। একই সড়কের পাশের পাশের স’মিলের কর্মী মো. বাবুল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ব্যাটারির রিকশা তো একেকটা দানব। ব্রেক ধরলেও এরা ১৫/২০ হাত পর গিয়া থামে। সব সময় কি এত জায়গা পায়? সামনে গাড়ি থাকে, মানুষ থাকে। তখন এক্সসিডেন্ট করে। বেড়িবাঁধে প্রতিদিন ৫/৬টা এক্সসিডেন্ট তো হয়ই।’
রিকশা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পায়ে চালিত রিকশায় যে ব্রেক লাগানো হয়, ওই একই ব্রেক লাগানো হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশায়। আ স্বীকার করেছেন ব্যাটারির রিকশার চালক ও মালিকরা।
রিকশার মালামাল বিক্রি হয় এমন একটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ব্রেক দুই ধরণের হয়। লাল ও সবুজ। এরমধ্যে লাল রঙের এক জোড়া ব্রেক ৩০ টাকা এবং সবুজ রঙের এক জোড়া ব্রেক ৩৫ টাকা। যা সাধারণ রিকশার গতিকে রোধ করতে সক্ষম। তবে ব্যাটারিচালিত গতিশীল রিকশার ক্ষেত্রে তা একেবারেই কার্যকর নয়।
অপরিকল্পিত এই বাহনের বিষয়ে আপত্তি আছে নগরে বসবাসকারী নাগরিকদের একাংশের। বিশেষ করে এই পরিবহনের গতি এবং ব্রেক।
ঢাকাবাসী সংগঠনের সভাপতি শুকুর সালেক ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এই পরিবহনটাই ঠিক নাই। এদের ব্রেক কাজ করে না। যে গতিতে চালায়, তা অস্বাভাবিক। নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকার বংশাল, তাঁতিবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন ব্যাটারির রিকশা তৈরি হচ্ছে। ঢাকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এদেরকে থামাতে হবে। একটা রিকশায় একজন চালক থাকে, দুইজন যাত্রী থাকে। এই তিনজনের প্রাণ নির্ভর করে ওই ৩০ টাকার ব্রেকের ওপর। এটা তো হতে পারে না।’
ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাব বলে মনে করে যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সংস্থাটির সভাপতি মোজাম্মেল হক ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আমাদের দেশে যে পরিবহনগুলো চলে সেগুলো দেখা শোনার জন্য অথরিটি আছে। এবং কিছু কিছু বিশেষজ্ঞও কাজ করে।
তিনি বলেন, আপনি যে বিষয়টি অনুসন্ধান করে নিয়ে আসলেন, এটা তো আমাদের বোর্ডের দেখার কথা ছিলো, বিআরটিএ’র দেখার কথা ছিল। মন্ত্রণালয়, সর্বোপরি যারা অনুমোদন দিচ্ছে, তাদের দেখার কথা ছিল। আসলে যারা দেখবার কথা, তারা কিন্তু জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমাদের জাতির মেরুদণ্ড এই অটোরিকশাগুলো ভেঙে দিচ্ছে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এহসানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা রিকশার কোনো পরিবর্তনই করে নাই। রিকশা হচ্ছে ১০ কিলোমিটার বেগে চলার মতো একটা বাহন। তারা সেটাকে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে চালাচ্ছে। এতে তো সমস্যা হবেই। বিপদ বাড়বেই।
তিনি বলেন, আমরা সাধারণত রিকশাকে ৩০/৪০ কিলোমিটার গতি চলার পরামর্শ দেই না। রিকশা ওই স্পিডের জন্য ডিজাইন না। রিকশা একশো বছর আগের একটা ডিজাইন। সেটা ১০ কিলোমিটার, ১২ কিলোমিটার গতিকে ব্যালেন্স করার জন্য। কিন্তু আপনি যদি এখন এটাকে পাঁচশো ওয়াটের মোটর লাগান, তাহলে তো এই বাহনে সমস্যা হবেই।
আবার এই ব্যাটারিচালিত রিকশার গতির বিপরীতে, যে ব্রেক দেওয়া হয়েছে, তাতে এই বাহনকে ‘ব্রেক ছাড়া’ পরিবহন বলে আখ্যায়িত করেছেন কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এই সহকারী অধ্যাপক বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি, ভর-বেগের সঙ্গে এর ব্রেক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটি একটি ব্রেক ছাড়া গাড়ি। সাধারণ রিকশায় মোটর লাগিয়ে শুধু এর গতি বাড়ানো হয়েছে।
ফলে এই পরিবহনের মাধ্যনে দুর্ঘটনার সম্ভবনা স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন দেশের গবেষকরা।
কারই/এএস