সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ঢাকা

রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশের

ইকরামুল হক নিলয়
প্রকাশিত: ২৭ মে ২০২২, ১০:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশের
ফাইল ছবি

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোয় আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ে উদ্বেগ ক্রমাগত বাড়ছে। দীর্ঘ সময়ে একদিকে যেমন প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তায় রোহিঙ্গারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে ইউক্রেন ও আফগানিস্তানের চলমান পরিস্থিতির কারণে বিপুল পরিমাণ এই জনগোষ্ঠীর সহায়তা তহবিলে সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পাশাপাশি বিশ্ব নেতাদের মিয়ানমার সরকারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টির কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, সম্প্রতি ভারত থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়েও দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশ। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৬ মে) রাত ৮টার দিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ‘বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটি’র বৈঠক শেষে এই উদ্বেগের কথা জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ভারত থেকে কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের পুশব্যাক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা তাদের ভারতেই পাঠিয়ে দেবে।


বিজ্ঞাপন


স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক কারবার উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গারা মাদক কারবারসহ নানা অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা বেষ্টনি আরও জোরদার করা হবে, যাতে প্রয়োজন ছাড়া রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে না পারে। সেই সঙ্গে যারা ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছে তাদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

Rohingya

অন্যদিকে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তাতেই এমন সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ক্ষোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তার কারণে হতাশ হয়ে পড়ছে, যার একটি সম্ভাব্য ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, এটি তাদের অনেককে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে প্ররোচিত করছে।’


বিজ্ঞাপন


সৌজন্য সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১১ লাখের বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কারণে গভীর বনভূমি কক্সবাজারের উখিয়ার পরিবেশও নষ্ট হয়েছে। তারা গাছ কাটার মাধ্যমে বনভূমি হ্রাসসহ এলাকার পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।

এ সময় রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়েও ইউএনএইচসিআরকে বাংলাদেশের আশঙ্কার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই হিসেবে প্রতি বছর দ্রুত আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা।

তবে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে ইউএনএইচসিআর এর হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান সরকার প্রত্যাবাসন শুরু করতে রাজি হয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ইউএনএইচসিআর সার্বিক সহায়তা করবে।

যদিও সংশ্লিষ্টদের দাবি একক প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গাদের ফেরানো দুরূহ। এ জন্য প্রয়োজন বিশ্বনেতাদের একজোট হয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপর রোহিঙ্গা প্রত্যাবসানে জোর চাপ সৃষ্টি করা।

Rohingya

বিষয়টিতে বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট ইউনিটের (রামরু) সাবেক চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো উদ্যোগের গুণগত অগ্রগতি আমরা এখন পর্যন্ত দেখতে পাইনি। তারা নিজেদের স্বার্থই দেখছে। আর এখন নতুন বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কমে আসছে। এটার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ পড়ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এর দায় নিতে হবে। তারা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।’

অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তৎপরতা জোরদার করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে এই সমস্যাটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমি মনে করি, সহসাই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই রোহিঙ্গাদের এখানে কর্মক্ষম করে তুলতে হবে। তাদের শিক্ষিত এবং দক্ষ করার জন্য নতুন নীতি নিতে হবে। শরণার্থী কমিউনিটিকে যুক্ত করে এখন কাজ করতে হবে। তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে যে, তাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তারাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’

অন্যদিকে, সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হকের মতে, ‘রোহিঙ্গা বিষয়টি যেন সবাই ভুলে যেতে বসেছেন। এমনকি বাংলাদেশও যেন ভুলে যাচ্ছে। সবাই যেন মনে করছে, রোহিঙ্গাদের থাকার একমাত্র জায়গা বাংলাদেশ। তা না হলে ভারত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের কোনো উচ্চবাচ্য নেই।’

গণমাধ্যমকে তিনি আরও বলেন, ‘ইউরোপ এখন ইউক্রেনের শরণার্থীদের নিয়ে আছে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে যে রোহিঙ্গারা এখানে আছে, তা নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ট বলে আমি মনে করি না। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান। তার কোনোই অগ্রগতি নেই। আর বাংলাদেশ কত চাপ নেবে? বাংলাদেশকে এখন সর্বোচ্চ জোর দিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো উচিত। মিয়ানমারের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিকভাবে আরও বেশি যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’

Rohingya

এতসব আশঙ্কা আর উদ্বেগের মাঝে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে বাংলাদেশ সরকারও নানামুখী তৎপরতা গ্রহণ করছে। বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান ‘গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে এখন ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অবস্থান করছেন। তিনি সেখান থেকে টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা যেন অব্যাহত থাকে তা নিয়ে আমরা এখন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। বালিতে জাতিসংঘের ডেপুটি সেক্রেটারি, সাধারণ পরিষদের সভাপতি, ইউএনডিআরআর-এর প্রতিনিধির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বলেছি। তারা বলেছেন, যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তা অব্যাহত থাকবে।’

তিনি ইউএনএইচসিআর-এর রোহিঙ্গা বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডির সঙ্গেও আলোচনা করেছেন বলেও জানান। সেই সঙ্গে ফিলিপ্পো গ্রান্ডি প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা যাতে না কমে সে জন্য তারা অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সবাইকে বলছি, বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। আমরা এলডিসি থেকে গ্রাজুয়েশন করে মাত্র ডেভেলপিং কান্ট্রিতে যাচ্ছি, তাই রোহিঙ্গাদের সহায়তা কমে গেলে আমাদের জন্য অসুবিধা হবে। আমরা চাপে পড়বো। সবাই আমাদের আশ্বস্ত করছেন।’

অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও কার্যকর পদক্ষেপের কথা ভাবছে সরকার। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা দেখেছি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্মহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগকে বলবো, সবাইকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে উদ্ধুদ্ধ করুন। সে জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছি। এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

সবমিলিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিষয়টিতে চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি বিশ্ব নেতাদেরও এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর