শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষা

সেলিম আহমেদ
প্রকাশিত: ২৬ মে ২০২২, ০৯:২০ এএম

শেয়ার করুন:

স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষা

সন্ধ্যার ঘুট ঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে প্রমত্তা পদ্মায়। তীরের মাওয়া ফেরিঘাট সংলগ্ন দোকানগুলো দিচ্ছে মিটমিটে আলো। তাতেই আবছা দেখা যাচ্ছে কালো রঙের এক রেখা। স্বপ্নের পদ্মা সেতু। 

সময় বুধবার (২৫ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। মাওয়াঘাটে মোটরসাইকেল নিয়ে ফেরির অপেক্ষায় ছিলেন শরীয়তপুরের নাড়িয়ার উজ্জ্বল ঢালি। নদী পার হয়ে যাবেন ওপারের মাঝিরঘাটে। ঢাকা মেইলের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, অল্প কয়েক মিনিটের জন্য ফেরি মিস করেছি। এরপর পরের ফেরির জন্য ঘণ্টা-দেড়েক থেকে অপেক্ষা করছি। জানি না পরের ফেরি কখন আসবে। আর কখন নদী পাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছাব।


বিজ্ঞাপন


আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে যানচলাচল শুরু হবে, অনুভূতি কী— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু সত্যিই আমাদের স্বপ্নের সেতু। এমন সেতুর জন্য আমরা দক্ষিণবঙ্গের লোকজন যুগ যুগ থেকে অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের স্বপ্ন পূরণ করলেন। এবার শুধু ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষা। 

উজ্জ্বল ঢালি বলেন, ব্রিজ চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের জীবনমান পাল্টে যাবে। যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হবে। ইতোমধ্যে আমাদের এলাকায় জায়গা-জমির দাম বেড়েছে। নানা উন্নয়নযজ্ঞ শুরু হয়েছে। আরও হবে। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ আর পিছিয়ে থাকবে না।

ফেরীঘাটে অপেক্ষায় থাকা আরেকজন মাদারীপুর সদরের রুবেল ব্যাপারী। তিনি বলেন, ব্রিজ চালু হলে যেমন ফেরীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না ঠিক তেমনি আমাদের জীবনমান আর থমকে থাকবে না। ‍দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে যাবে। 

তিনি আরও বলেন, এক ব্রীজের জন্য আমরা কত ভোগান্তির শিকার হয়েছি তা এ অঞ্চলের মানুষ ছাড়া কেউ বুঝবে না। ব্রিজ চালু হলে ভোগান্তি কমবে। ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।


বিজ্ঞাপন


আরেকজন দীপংকর গৌতম। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক। বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া। ব্রিজ নিয়ে অনুভূতি কী জানতে চাইলে শোনান জীবনের এক গল্প। গল্পের সময়কাল ১৯৯৩ সাল। ওইবছরের এক দুপুরে হার্টঅ্যাটাক করেন তার মা অনিমা গৌতম। তখন সেই অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান এতো ভালো ছিল না। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার পথে রওয়ানা হন। আরিচা ফেরিঘাটে এসে দেখে গাড়ির তীব্র চাপ। ৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফেরিতে উঠেন। কিন্তু ঢাকা পৌঁছার আগেই ওপারে চলে যান তার মা। 

শুধু দীপংকরের মা নন এভাবেই অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে চিকিৎসার অভাবে কত মানুষ হারিয়েছেন তার স্বজনকে। ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন হাজার হাজার মানুষ। কত কৃষকের স্বপ্নের ফল বিক্রি করতে হয়েছে কম দামে আর কত জনের ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হয়েছে। ফেরি পার হতে না পেরে চাকরির পরীক্ষায় বসতে না পেরে কত তরুণের স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হয়েছে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলাকে রাজধানীসহ সারাদেশে দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল খরস্রোতা নদী পদ্মা। সেসব অঞ্চলের প্রত্যাশিত উন্নয়নের সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই নদীটি। আর সেই কারণেই স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের আপামর মানুষ স্বপ্ন দেখতেন একটি সংযোগ সেতুর। দেশ স্বাধীন হলো, সরকার এলো, সরকার গেল- কেউ পূরণ করতে পারলো না দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের এই স্বপ্ন। অবশেষে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখালেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিশ্বব্যাংকের অযাচিত টালবাহানাসহ নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে স্বপ্নকে রূপ দিলেন বাস্তবে। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ডিসেম্বরেই অবয়ব পায় সারাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত সেই স্বপ্ন। সেতুটি খুলে দিলে দূরত্ব কমবে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের। দুই অঞ্চলের অর্থনীতিতেই ঘটবে উল্লম্ফন। সেই সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিও লাভবান হবে বলে আশা করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

পদ্মা সেতু দেখতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে এসেছেন সাংবাদিক সৈয়দ আশফাক তানভীর। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু দেশের অন্যতম একটি মেগাপ্রকল্প। স্বপ্নের এই প্রকল্পে দেখতে এসেছি। ঢাকায় এসেছিলাম ব্যক্তিগত কাজে, সময় বের করে দেখতে এলাম সেতুটি। এটি আমাদের দেশের গৌরব। দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে বলে আমি মনে করি।

নানা বাধা ও আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে আসছে ২৫ জুন। সেদিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। আর এ সেতুর নাম পদ্মা নদীর নামেই হবে বলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন।

ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করেছে সরকার। সেতুতে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলেও বুধবার (২৫ মে) জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। এরপর দ্রুত গতিতে শেষ হয় আনুষাঙ্গিক অন্যান্য কাজ।

দুই তলা বিশিষ্ট সেতুর উপরের অংশের রাস্তা আগামী ২৫ জুন চালু হলেও নিচের অংশের রেল আগামী মার্চ মাসে চলবে বলে গত ১৫ জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।

পদ্মার মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো।

এসএএস/এএস 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর