‘গুলি লেগে রক্ত ঝরছিল। সময় যত গড়াচ্ছিল তত খারাপ হচ্ছিল। আমি তখন কালেমাও পড়ছি এই ভেবে যে, আমি তো মরে যাব! কারণ, আমার পাশে তিনজন গুলি খেয়ে তখন মরে পড়েছিল।’
কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে শেরপুরে গুলিতে আহত শেরপুর কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সজীব মিয়া।
বিজ্ঞাপন
গত ৪ আগস্ট শেরপুর সদরের খরমপুর এলাকার কলেজ মোড়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছোড়া ছররা গুলিতে আহত হন বলে দাবি সজীবের। তার আগে সেখানে পুলিশের গাড়িচাপায় তিনজন নিহত হয়। এ খবর সেদিন গণমাধ্যমে আলোচিত ছিল। কিন্তু পুলিশের গাড়িচাপা দিয়ে চলে যাওয়ার পর সেখানে কি ঘটেছিল তা অনেকের অজানা। সম্প্রতি সেই কথাই ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে এখন চিকিৎসাধীন সজীব। ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, সেদিন বিকেলে আমরা আন্দোলন করছিলাম। এর মাঝে হঠাৎ করে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে দিয়ে চলে যায়। ফলে আমরা তাদের ধরতে পারিনি। কিন্তু পরক্ষণেই তাদের পেছনে পেছনে আসে যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের কর্মীরা। তারা এসেই গুলি করতে শুরু করে। আমরা চার থেকে পাঁচ হাজার লোকজন থাকলেও তাদের গুলির কারণে সেখানে টিকতে পারিনি। দৌড়াতে গিয়ে এক পর্যায়ে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। এসময় অনেকগুলো ছররা গুলি এসে লাগলে আমি পড়ে যাই। এক মিনিটের মতো হাঁটতে পারছি। তারপর পড়ে গেছি। অজ্ঞান হওয়ার পর কি হয়েছে জানিনা। দুই আড়াই ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে। তার আগে যখন রক্তাক্ত হয়ে আর হাঁটতে পারছিলাম না, পুরো শরীরে ছররা গুলিতে রক্ত ঝরছিল, শক্তি কমে আসছিল। ফলে তখন বারবার মনে হচ্ছিল মরে যাব! এক পর্যায়ে আমি কালেমাও পড়েছি।
সেদিন যা ঘটেছিল
তার ভাষ্যমতে, সেদিন আন্দোলনকারীদের ওপর দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে দেয় পুলিশের গাড়িচালক। এতে ঘটনাস্থলে দুইজন এবং পরে হাসপাতালে একজন মৃত্যু হয়। পুলিশ গাড়িচাপা দিয়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের পেছনে ঢাকা যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের মধ্যে দুইজনের হাতে ছিল শটগান এবং দুজনের হাতে ছিল পিস্তল। এই হামলায় নেতৃত্ব দেয় জেলা যুবলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি সানোয়ার হোসেন সানো এবং শেরপুর পৌর মেয়র। আর তখন অস্ত্রগুলো চালায় যুবলীগের হুমায়ুন কবির রোমান, যুবলীগ সভাপতি হাবিব চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি সানোয়ার হোসেন সানো। আরও একজনের হাতে তিনি অস্ত্র দেখেছেন কিন্তু সেই ব্যক্তিকে চিনতে পারেননি।
বিজ্ঞাপন
শটগান থেকে ছররা গুলি করা হয়েছে বলে দাবি করেন সজীব। ওই সময় আশপাশে কোনো পুলিশ সদস্য ছিল না। ফলে গুলিগুলো যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীই করেছে বলেও যোগ করেন তিনি।
হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সদের হুমকি!
ঘটনাস্থলে গুলি খাওয়ার পর শেরপুর জেলার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে উপস্থিত নার্স এবং চিকিৎসকরা তাকে নানা ভয়ভীতি দেখান। তারা বলতে থাকেন এটা পুলিশ কেস। পুলিশ আসবে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। এরপর তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চলে যান। সেখানে সারারাত লুকিয়ে ছিলেন যাতে পুলিশ খুঁজে না পায়। কিন্তু পরদিন ৫ আগস্ট আবারও তিনি জেলা সদর হাসপাতালে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেননি। সেখান থেকে তাকে দ্রুত কেটে পড়ার হুমকি দেন তারা। এক পর্যায়ে সেখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে আরেকটি প্রাইভেট হাসপাতালে যান তিনি। সেই হাসপাতালে তার শরীর থেকে ছয়টি ছররা গুলি বের করা হলেও বাকিগুলো বের করা সম্ভব হয়নি, যা এখনো শরীরে রয়েছে। সেদিন বিকেলে বাড়ি যাওয়ার পর পরের দিন ময়মনসিংহ জেলা সদর হাসপাতালে যান। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে প্রায় ১৯ দিন পর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে তাকে রেফার্ড করেন চিকিৎসকরা। এখন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
এমআইকে/এমএইচটি