মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাজমিস্ত্রি শাহীন

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাজমিস্ত্রি শাহীন

ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন মোহাম্মদ শাহীন। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় টেলিভিশনে গুলিতে ছাত্রদের নিহত হওয়ার দৃশ্য দেখে বাসায় থাকতে পারেননি। অনেকের মতো তিনিও নেমে পড়েন মাঠে।

শাহীনের ভাষ্যমতে- আন্দোলনে নেমে ১৬ থেকে ২০ জুলাই মাঠে থাকেন তিনি। কিন্তু ২০ জুলাই বিকেলে গুলি লাগে তার শরীরে। চুপিসারে দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ছিলেন তিনি। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু গুলি লাগা পায়ে এখনো অনুভূতি আসেনি তার। পায়ের বেশি কিছু রগ অকেজো হয়ে পড়েছে।


বিজ্ঞাপন


গত বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) বিছানায় শুয়ে ঢাকা মেইলের প্রতিবেদকের কাছে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেন তিনি।

শাহীন জানান, তার বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। তিনি সদরের দফাদার বাড়ির কায়ছের মালের ছেলে। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার তার। তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

শাহীন গত ১৬ জুলাই থেকে টানা চারদিন মাঠে থাকলেও অক্ষত ছিলেন। গত ২০ জুলাই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাস্তাঘাটে পিকেটিংও করেছেন এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু বিকেলে বেলা গড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে আল্লাহ করিম মসজিদের সামনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ধাওয়া খেয়ে অন্যদের সঙ্গে বেড়িবাঁধ চৌরাস্তার দিকে এগিয়ে যান তিনি। ওই মুহূর্তে মোহাম্মদপুর থানার দিক থেকে ছুটে আসা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে আসতে থাকেন। তাদের ছোড়া একটি বুলেট শাহীনের পায়ে লাগলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওই সময় আন্দোলনকারীদের একজন তাকে দ্রুত রাস্তা থেকে সরিয়ে নেন বলে জানান শাহীন।

সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে আহত এই রাজমিস্ত্রি জানান, তারা সারাদিন আন্দোলন করার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিকেলে ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ তাদের গুলি করতে শুরু করে। তারা তখন সমানে গুলি করছিল। তিনি ওই সময় প্রাণ বাঁচাতে ক্লান্ত শরীরে দৌড়াতে না পেরে হাঁটা শুরু করেন। এ সময় সরকারপন্থীরা গুলি ছুড়ছিল আর তারাও সমানে ইট পাটকেল মারছিলেন। গুলিতে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হতাহত হতে দেখেছেন তিনি।


বিজ্ঞাপন


দুই কাউন্সিলর ও ছাত্রলীগ নেতা গুলি চালায়

গুলিবিদ্ধ শাহিনের ভাষ্যমতে, ঘটনার দিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ এবং একই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব। এছাড়াও মোহাম্মদপুর ছাত্রলীগের নেতা আরিফুর রহমান তুহিন মিয়া, মোহাম্মদপুর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আইমান ওয়াসেফ অমিক ও ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানকের পিএস মাসুদুর রহমান বিপ্লব আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিল থেকে গুলি ছোড়েন। শাহীন তাদের পিস্তল দিয়ে গুলি করতে দেখেছেন।

শাহীন জানান, পিস্তল দিয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের লোকজন আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়ছিল। আন্দোলনকারীরা মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ যাওয়ার সড়কের ময়ূর ভিলার সামনে আসার পর নানকের পিএস বিপ্লব এবং কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ গুলি করে দুই ছাত্রকে হত্যা করেন। তাদের ছোড়া গুলিতে সেদিন কয়েকজন নিহত হন। তবে সেই দুই কাউন্সিলর, ছাত্রলীগ নেতা তুহিন এবং নানকের পিএস বিপ্লব এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের কাউকে এলাকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

শাহীন আরও জানান, সেদিন গুলি করা ছাড়াও ছাত্রলীগ যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা যেসব আন্দোলনকারীকে পেয়েছেন তাদের ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহতও করেছেন। তবে শাহীন নিজে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন বলে জানান।

ঢাকা মেইলকে শাহীন বলেন, ‘গুলি লাগার পর আমি পড়ে যাই। পরে আমারে শ্যামলীর একটি হাসপাতালে নেয়। কিন্তু হাসপাতালের কেউ চিকিৎসা দিবার চায় না। আমাদের কইতাছিল ভাই রাখা যাব না, সরকারে গুলি খাওয়া রোগী রাখা নিষেধ আছে। পরে পঙ্গুতে আসলাম। এরা আমারে না দেইখা কইতাছিল পা কাইটা ফালাইবো। পা না দেইখাই তারা আমারে পঙ্গুত্বের সার্টিফিকেট ধইরা দিতাছিল। পরে পপুলারে যাইয়া আমার চার লাখ টাকা খরচ হইছে। সেখান থাইক্যা বাসায় গিয়া থাকছি। পরে শুনতাছি পঙ্গুতে বিনা খরচে সরকার আমাগো চিকিৎসা দিতাছে। এই চারদিন থাইক্যা এখানে আছি। এখানে চিকিৎসা নিতাছি কারণ প্রাইভেটে তো অনেক টাকা লাগে। স্যাররা কইছে।’

শাহীনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার পায়ে একটি গুলি লাগে। সেই গুলিতে তার পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু রগ অকেজো হয়ে গেছে। এখনো তিনি পায়ের পাতা নড়াতে পারেন না। তার গুলি লাগা অংশে চামড়া পরে যাওয়ায় পায়ের রানের চামড়া কেটে সেখানে লাগানো হয়েছে। এই পা সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কতদিন সময় লাগবে তা বলতে পারছেন না। ফলে সংসার তার কীভাবে চলবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা ভর করেছে রাজমিস্ত্রি শাহীনের।

এমআইকে/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর