বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

বিশেষজ্ঞদের ধারণার বাইরে ছিল এবারের বন্যা

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০ এএম

শেয়ার করুন:

বিশেষজ্ঞদের ধারণার বাইরে ছিল এবারের বন্যা
ফাইল ছবি

চলতি মাসের শুরুতে স্বল্প মেয়াদে বন্যা ও অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। বিশেষ করে বন্যা পরিস্থিতি বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করতে পারে এমন পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেশের ১০ জেলার ওপর দিয়ে প্রবল মাত্রার যে বন্যা এখন বয়ে যাচ্ছে তা সংশ্লিষ্টদের ধারণার বাইরে বলে জানা গেছে। যে কারণে অল্প সময়ের মধ্যে এই ধরনের আকস্মিক ও প্রবল মাত্রার বন্যার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া অসম্ভব বলে মনে করছে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

তবে পানিবন্দি মানুষের জন্য পুরো দেশজুড়ে যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, তখন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, মৌলভীবাজার, ফেনীর উজানের কিছু পয়েন্টে পানির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান এবারের বন্যার বিষয়ে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এমন প্রবল বন্যার অনুমান ছিল না। পরবর্তীতে লঘু চাপের কারণে বৃষ্টির তীব্রতা বেড়ে যায়। একদিকে উজানে নদীর পানি বেড়ে গেছে, অন্যদিকে ভারি বৃষ্টিপাত। দুইয়ে মিলে অতি প্রবল বন্যার কবলে পড়তে হয়েছে। এত অল্প সময়ে এমন ভয়াবহ বন্যা নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া আসলেই কঠিন।

আরও পড়ুন

উচ্চতার কারণে পানি উপচে পড়েছে: ভারতীয় হাইকমিশনার

এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা বন্যার পেছনে ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়ার অভিযোগ তুললেও দেশটির পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে।

ত্রিপুরার বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, ‘এত বৃষ্টিপাত হয়েছে এটা ভারতেরও ধারণার বাইরে ছিল।’


বিজ্ঞাপন


flood_1

বানের জলে ভাসছে মানুষ

আকস্মিক বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। বন্যা হচ্ছে ভারতেও। ইতোমধ্যে দেশের ১০ জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ পানিবন্দি ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। টানা বৃষ্টির পাশাপাশি বাংলাদেশে বন্যার পেছনে ত্রিপুরার গোমতী নদীর বাঁধ খুলে দেওয়াকে দায়ী করছেন অনেকে।

বিশেষ করে ফেনী, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও খাগড়াছড়ি এসব এলাকার মানুষের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

যদিও বাঁধের পানি ছাড়া নিয়ে ভারত বলছে, পানির চাপে সৃষ্ট ভূমিধসে মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) সিকিমের তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী একটি বাঁধ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়াকে বাংলাদেশে বন্যার কারণ বলা হলেও বিষয়টি তথ্যগতভাবে সঠিক নয়।

আরও পড়ুন

বন্যায় আর্থিক ও ত্রাণ সহায়তা দিতে যোগাযোগের অনুরোধ সেনাবাহিনীর

বন্যা পূর্বভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উত্তর–পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের প্রধান সাতটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৬ আগস্ট থেকে এসব অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ১৮ আগস্ট সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপ স্থলে প্রবেশ করে। এতে দেশের মধ্যাঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়।

বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা দশটি। সেগুলো হলো, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এসব এলাকায় বন্যার কবলে পড়েছেন ৩৬ লাখ মানুষ।  

flood_4

বন্যায় ফেনীতে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন মারা গেছেন বলেও তথ্য বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয় জানায়, বন্যায় পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মোট ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন লোক এবং ৭ হাজার ৪৫৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, গত চার দিন ধরে ভারতের ত্রিপুরায় গড়ে প্রায় দুইশ মিলিমিটার বৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে বিলোনীয়া ও অমরপুরে বিপদসীমার উপরে বইছে মুহুরি ও গোমতী নদীর পানি। এর প্রভাবে ভাটিতেও আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন

বন্যাদুর্গত এলাকায় যাবেন উপদেষ্টারা

বন্যা-ভারী বৃষ্টি নিয়ে কি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল?

প্রতি মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদফতর ওই মাসের আবহাওয়া পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয়। চলতি মাসের শুরুতে সেই পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এ মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর–মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণেই এ বন্যা হবে বলে জানানো হয়েছিল। এর মধ্যে আশঙ্কায় থাকা জেলাগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দেশের দশ জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।

image_114209_1724324077

বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত, সাগরের লঘুচাপ এবং সেই সঙ্গে পূর্ণিমার কারণে সাগরের জোয়ার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। সেই কারণে বৃষ্টির পানি নামার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে উজানের প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা কবলিত এলাকার নদীবাহিত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।

অন্যদিকে আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেছেন, বন্যা বা জলাবদ্ধতা যা–ই হোক, তা নির্ভর করে উজানে কতটুকু বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর। কয়েকদিন ধরে উজানে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে বৃষ্টিপাত, বন্যা পরিস্থিতিতে তার ৮ থেকে ১০ শতাংশ অবদান থাকে। উজানের ভারী বৃষ্টির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টির কারণে আমাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

আগামী দু-এক দিন উজানে ভারী বৃষ্টির সম্ভবনা আছে এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফেনী বা কুমিল্লা অঞ্চলে ভারী বর্ষণের প্রবণতা আগামীকাল (শুক্রবার) বিকেল থেকে কমে আসতে পারে।

আরও পড়ুন

চারিদিকে থৈ থৈ পানি, দুর্ভোগের অন্ত নেই বানভাসী মানুষের

বন্যা নিয়ে কি করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার?

চলমান ভয়াবহ বন্যায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সকল উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনূস। তার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জেনেছি ১০টি জেলায় ৩৬ লাখের বেশি মানুষ বন্যা কবলিত। এই ৩৬ লাখ মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ আমরা নিয়েছি।

এদিকে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ সরকার। ত্রাণ ও দুর্যোগ উপদেষ্টা ফারুকী আজম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।

তিনি জানিয়েছেন, ‘প্রথমত মানুষের জীবন বাঁচানো। এখনকার পরিস্থিতি হচ্ছে, সবার আগে মানুষের জীবন রক্ষা করা। স্বাভাবিকভাবে সরকার কাজ করছে, যাতে মানুষের জানমাল, গবাদিপশু ইত্যাদি রক্ষা করা যায়। এখানে ক্যাশ (অর্থ) এবং খাদ্যদ্রব্য পর্যাপ্ত আছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি।

বৃষ্টিপাত কমে পরিস্থিতি খানিকটা ঠিক হলে পুনর্বাসন কাজ শুরু করা হবে জানান ত্রাণ ও দুর্যোগ উপদেষ্টা।

বিইউ/এমএইচএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর