বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

মিটার চার্জের সঙ্গে জমার টাকা বাড়ানোর ফন্দি!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২১ মে ২০২২, ০৫:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

মিটার চার্জের সঙ্গে জমার টাকা বাড়ানোর ফন্দি!

সিএনজিচালিত অটোরিকশায় স্বস্তিতে চলার সুযোগ অনেক আগেই হারিয়েছেন যাত্রীরা। এর সবচেয়ে বড় কারণ ভাড়ায় নৈরাজ্য। মিটারে তো দূরের কথা, গন্তব্যে যেতে দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। চুক্তিতে চলাচলের কারণ হিসেবে মালিকদের বেশি জমা নেওয়াকে দুষছেন চালকরা।

চালকদের দাবি, মালিকপক্ষ সরকার নির্ধারিত জমার চাইতে বেশি টাকা নেয়। সেজন্য মিটারে অটোরিকশা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে মালিকপক্ষের দাবি, যন্ত্রাংশসহ সরকারি ভ্যাট-ট্যাক্স বেড়ে যাওয়ায় সরকার নির্ধারিত ৯০০ টাকা জমা রাখা সম্ভব নয়।


বিজ্ঞাপন


এমন অবস্থার মধ্যে জমার টাকা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন ঢাকা মহানগরে চলাচল করা অটোরিকশার মালিকরা। একইসঙ্গে মিটার চার্জ বাড়ানোরও দাবি করছেন তারা।

মালিকপক্ষের দাবির বিরোধিতা করে চালকরা দৈনিক জমার পরিমাণ না বাড়ানোর দাবি জানান। মালিকদের জমা বাড়ানোর প্রস্তাবকে নিজেদের আখের গোছানোর চিন্তা হিসেবে দেখছেন চালকরা।

CNG-3
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে অটোরিকশা ও মিশুক শ্রমিক ইউনিয়ন

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা মহানগর অটোরিকশা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের নেতারা নয় দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাদের দাবির দুই নম্বরে অটোরিকশার মালিকদের দৈনিক জমা ও চালকের মিটারের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি বলা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


অন্যদিকে প্রেসক্লাবের বাইরে কর্মসূচি পালন করেন ঢাকা জেলা সিএনজি অটোরিকশা, মিশুক চালক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।

ঢাকা জেলা ফোর স্ট্রোক (সিএনজি) অটোরিকশা ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে জমা বেশি নেয়, গ্যারেজ ভাড়ার নামে বাড়তি টাকা নেন মালিকরা। আর এখন শ্রমিক দরদি সেজে চালকদের সহযোগিতা নিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে চায় মালিকরা। আসলে তারা এখন দৈনিক জমার পরিমাণ বাড়াতে চাচ্ছে।’

মালিকদের সংগঠনের সদস্য সচিব এটিএম নাজমুল হাসান চালকদের অভিযোগ নিয়ে কৌশলী উত্তর দিয়েছেন। ঢাকা মেইলকে নাজমুল হাসান বলেন, ‘বেশিরভাগ মালিক নির্ধারিত ৯০০ টাকা জমা নেয়। সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা নেয়া হয়। এই একশো টাকার কথা কিন্তু বিআরটিএকে বলা আছে। এখন সবকিছুর দাম বেড়েছে তাই জমা না বাড়ালে চলা যাবে না।’

CNG-1
জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক ঐক্য পরিষদ 

বছরের পর বছর ধরে মালিকদের বাড়তি জমা আর ভাড়া নিয়ে এমন নৈরাজ্য চললেও বিআরটিএ ও পুলিশের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ যাত্রীকল্যাণ সমিতির। সংগঠনটি বলছে, ইচ্ছা থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে এই নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব।

অন্যদিকে মালিক-চালকদের অভিযোগ পুলিশ বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাদের ভাষ্য- কথায় কথায় মামলা দেওয়া, গাড়ি আটকে চাঁদা নেওয়া, রেকারিং করার পাশাপাশি কিছু পুলিশ সদস্যের যোগসাজশে ঢাকার বাইরের অটোরিকশা অবৈধভাবে ঢাকায় চলাচল করছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালে বেবিট্যাক্সি, টেম্পোসহ টু–স্ট্রোকবিশিষ্ট যানবাহন তুলে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের সিএনজিচালিত অটোরিকশা বরাদ্দের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০০৪ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় ঢাকায় ১৩ হাজার অটোরিকশার নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও কাছাকাছি সংখ্যার অটোরিকশা নামে।

এক পর্যায়ে নিবন্ধন বন্ধ করে দেওয়া হলেও ২০১৫ সালে ঢাকায় পুরোনো মিশুকের পরিবর্তে প্রায় দুই হাজার অটোরিকশার অনুমোদন দেয় বিআরটিএ। যেখানেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও অনুমোদন দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর থেকে মেয়াদ শেষে একই মালিকের নামে আবার নতুন অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়। যদিও বিপুল অর্থের বিনিময়ে অনেকে নিবন্ধন নম্বরসহ মালিকানা অন্যের নামে বদল করে ফেলেন।

ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১৫ হাজার অটোরিকশার নিবন্ধন রয়েছে। কিন্তু ঢাকায় ৩০ থেকে ৩২হাজার অটোরিকশা চলাচল করে। যেগুলোর বেশিরভাগ গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলার।

এদিকে ঢাকার বাইরের যেসব অটোরিকশা রাজধানীতে চলাচল করে সেগুলো বন্ধে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে মালিকদের সংগঠনটি। এই দাবিতে আগামী ২৩ মে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে তারা। এরপর ২৫ ও ২৬ মে ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘটে যাওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মালিকরা।

জমা হিসেবে চালকদের কাছ থেকে দৈনিক ৯০০ টাকার বেশি নেওয়ার কথা স্বীকার করে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদের সভাপতি মো. বরকত উল্লাহ বলেন, এছাড়া মালিকদের আর কোনো উপায় নেই। দৈনিক জমা অন্তত ১ হাজার ২০০ টাকা এবং মিটারে প্রতি কিলোমিটারে ২০ টাকা করতে হবে।

ভাড়ার নৈরাজ্যে অসহায় যাত্রী

প্রথমে অটোরিকশায় প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ১২ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেছিল সরকার। তখন নীতিমালায় বলা হয়েছিল, ঢাকায় সিএনজি স্টেশন বাড়লে ভাড়া আরও কমানো হবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি স্টেশনের সংখ্যা বাড়লেও কমেনি ভাড়া। সবশেষ ২০১৫ সালে প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য সাড়ে ১২ টাকা। কিন্তু হাতেগোনা কিছু ছাড়া কোনো অটোচালক মিটারে চলতে রাজি নন।

CNG-4
প্রেসক্লাবের সামনে ঢাকা জেলা ফোর স্ট্রোক (সিএনজি) অটোরিকশা ড্রাইভার্স ইউনিয়নের বিক্ষোভ সমাবেশ 

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ বলছে- রাজধানীতে মাত্র দুই শতাংশ অটোরিকশা মিটারে চলে। মিটারে চলা অটোরিকশার ৯২ শতাংশ ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া বা বকশিশ দাবি করে। আর বৃষ্টি বা গণপরিবহন সংকটকালে বকশিশের পরিমাণ বেড়ে যায়।

৮৮ শতাংশ চালক যাত্রীদের চাহিদামতো গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না বলেও জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। আর চুক্তিতে চলাচলকারী অটোরিকশা চালক মিটারের ভাড়া থেকে সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৭১০ দশমিক ৮১ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।

অজুহাতের অন্ত নেই চালকদের

যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে সেই চালকদের অজুহাতের যেন শেষ নেই। তাদের অভিযোগ, সিএনজি অটোরিকশার দৈনিক জমা ৯০০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও মালিকরা ১১০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। দৈনিক কমপক্ষে তিনশো টাকার গ্যাস লাগে। থাকা-খাওয়ার খরচ অনেক বেড়েছে।

অন্যদিকে যানজটের কারণে ট্রিপ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিশেষ করে রাইড শেয়ারিং চালু হওয়ার পর অনেকেই অটোরিকশায় চলা বাদ দিয়েছে বলেও দাবি চালকদের। এসব কারণে মিটারের বদলে চুক্তিতে চলতে বাধ্য হচ্ছেন বলে তাদের দাবি।

AUTOজাহিদুল ইসলাম নামে একজন অটোচালক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মানুষ তো অ্যাপসের গাড়িতে বা মোটরসাইকেলে যায়। আগে সব বাদ দিয়ে দিনে হাজার টাকাও রাখতে পারতাম। এখন ৬শ টাকাও কেটে না।’

সরকার আন্তরিক হলে অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে নৌরাজ্য দূর করা সম্ভব এমন মন্তব্য করে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই খাতে দৈনিক বিপুল টাকা অবৈধভাবে লেনদেন হয়। কারা টাকা নেয়, কিভাবে নেয় সেটাও পরিষ্কার। এ কারণেই নৈরাজ্য থামছে না। কিন্তু আইনের প্রয়োগ ও সরকার আন্তরিক হলে অটোরিকশার ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করা কোনো ব্যাপার না।’

বিইউ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর