দিনে দিনে সৌন্দর্য হারাচ্ছে রাজধানীর অন্যতম দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র হাতিরঝিল। বিভিন্ন স্থানে ফেলা হচ্ছে গৃহস্থালি ও দোকানের বর্জ্য। সেই সঙ্গে পানিতে ভাসছে ময়লা। বাতাসেও বাড়ছে উৎকট গন্ধ। পাশাপাশি বেড়েছে মাদকসেবীদের আনাগোনা।
এদিকে, নগরীর প্রাণকেন্দ্রের এই বিনোদন কেন্দ্রের ড্রেনগুলোর ওপর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোহার গ্রিলও। পাশাপাশি প্রায় সবগুলো স্পেশাল সুয়ারেজ ডাইভারসন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) বন্ধ হয়ে আছে। সেই সঙ্গে কমেছে সবুজের সমারোহ। এছাড়া রাতে জ্বলে না ল্যাম্পপোস্টের বেশকিছু বাতি।
বিজ্ঞাপন
তবে বিদ্যমান এই সমস্যাগুলোর কথা স্বীকার করলেও কিছু করতে পারছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। যেন ‘দেখা যাক কী হয়’ নীতি গ্রহণ করেছে সংস্থাটি।
২০১৩ সালে উদ্বোধনের পর থেকে হাতিরঝিলের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন (এসডব্লিউও)। গত বছরের ৩০ জুন রাজউকের কাছে প্রকল্পটি হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী। যদিও রাজউক বলছে, সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বরাদ্দের অভাবে বিশেষ কিছু করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তবে এখনও সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঝিলের পাশে ওয়াকওয়ের ওপর নির্মিত ড্রেনগুলোর গ্রিল খুলে নেওয়া (চুরি) হয়েছে। যেখানে একটু অসতর্ক হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। মধুবাগসহ কয়েকটি এলাকায় বাসাবাড়ির ময়লা সরাসরি পড়ছে হাতিরঝিলে। এর মধ্যে মহানগর এলাকা সংলগ্ন হাতিরঝিল ১ নম্বর পানির পাম্পের পাশে খোলা আকাশের নিচে (বিস্তৃত জায়গাজুড়ে) ফেলা হচ্ছে বাসাবড়িসহ দোকানের বস্তাবন্দি ময়লা। যে কারণে উৎকট গন্ধে পাশ দিয়ে হাঁটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
এর কিছুটা সমনেই বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মূল কার্যালয়। তার পাশেই অজানা কারণে বন্ধ রয়েছে ফুটওভার ব্রিজের নির্মাণকাজ। তবে নির্মাণকাজের মালামালগুলো রাখা হয়েছে রাস্তার ওপর। এছাড়া ঝিলের বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্তভাবে মল-মুত্র ত্যাগ করতেও দেখা গেছে অনেককে। আর সন্ধ্যা পর থেকেই প্রায় সময়ই অনেকে জড়ো হয়ে মাদকদ্রব্য গাঁজায় মত্ত হতে দেখা যায়।
এদিকে, ময়লা ফেলার ডাস্টবিনগুলো বেশিরভাগ স্থানেই নেই। আর যেগুলো আছে, সেগুলো আগুনে পোড়া কিংবা ভেঙে পড়ে আছে। পাশাপাশি হাতিরঝিলে বেড়েছে ভবঘুরে মানুষের আনাগোনা। সেই সঙ্গে হাঁটার পথে বেশ কয়েক স্থানেই নেই মেনহলের ঢাকনা।
অন্যদিকে, বেশকিছু স্থানে জমেছে ময়লার স্তূপ। বেগুনবাড়িসহ বেশ কয়েকটি স্থানে হাতিরঝিলের সীমানা প্রাচীরের কাঁটাতার ঝুলে পড়েছে হাঁটার পথে। আর সড়কের কয়েকটি স্থানে নামছে না বৃষ্টির পানি। পাশাপাশি দুই রাস্তার মাঝের গাছগুলোও মরে যাচ্ছে। এরমধ্যে কয়েকটি গাছ কে বা কারা যেন আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও গাছগুলো থেকে আগাছাও পরিষ্কার করা হচ্ছে না নিয়মিত। যার প্রভাব পড়ছে পুরো ঝিলজুড়ে।
রাজউকের একাধিক সূত্রে জানা যায়, সমস্যাগুলো সমাধানে তারা কাজ করছেন। তবে এর আগে প্রকল্প হস্তান্তরের পূর্বে রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে জটিলতার কথা জানানো হয়েছিলো খোদ মন্ত্রণালয়কে। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিপিপিতে কোনো বরাদ্দ বা নির্দেশনা ছিল না। যার জন্য প্রয়োজন বছরে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। যেখানে প্রকল্প এলাকায় দোকানসহ আয়যোগ্য খাতগুলো থেকে বছরে আয় ১০ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি মেটাতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চাওয়া হলেও মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাজউককেই দিতে হবে খরচ। যেখানে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের প্রস্তাব তৈরি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটি নিয়ে ২০২০ সালের ২ জুন রাজউক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সভা হয়। যেখানে বলা হয়- হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি খাল পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে একটি স্টর্ম ওয়াটার বেসিন করা হয়েছে। জলাধার ও সবুজের সমারোহে প্রকল্পটি পর্যটকদের কাছে বিনোদন কেন্দ্র হয়েছে। তাই এর রক্ষণাবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
এদিকে, প্রকল্প এলাকাজুড়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ১১টি স্পেশাল সুয়ারেজ ডাইভারসন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) এরই মধ্যে ব্লক হয়ে গেছে। যা খোলা নিয়েও কোনোপ্রকার আগ্রহ নেই সংস্থাটির।
অন্যদিকে রাজউক সূত্রে জানা যায়, দায়িত্ব পাওয়ার পর নিরাপত্তার জন্য তিন শিফটে ১৭১ জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা ও গাছের নিরাপত্তায় ৫৬ জন কর্মী রয়েছে। সব মিলিয়ে আছেন ২২৭ জন। এদের পেছনেও মাসে ব্যয় প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ টাকা।
রাজউক বলছে, ঢাকার বৃহৎ এলাকার ‘ক্যাচমেন্ট বেসিন’ হিসেবে হাতিরঝিলের লেকটি ব্যবহৃত হচ্ছে। যার রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহতের প্রভাব পড়বে শহরজুড়ে। সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা।
এসব বিষয়ে পরিকল্পনাবিদ মো. আকতার মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রথম কথা হলো- এ প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি। এখানে যে পানিটা যা ট্রেন থেকে আসে, বিশেষ করে পয়োবর্জ্য যেটা আসে, এটা হাতিরঝলের সঙ্গে মিলে-মিশে যায়। এর জন্য রামপুরা ব্রিজের ওপারে যে খালটা আছে, সে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা রকম প্রস্তাব ছিলো। যাতে করে লেকের পানিটা নষ্ট না হয়। এর জন্য আমি প্রথমেই বলবো, এটা আংশিকভাবে যেটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে, পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। কারণ, পানির পলিসিটা রক্ষা কারা না গেলে এই লেক ব্যবহার কার যাবে না। আমারা যেখানে চিন্তা করছি পানি পথে বা জলযোগাযোগ বৃদ্ধি কারার বিষয়ে, তাও করা যাবে না। মানুষ এটার পূর্ণ বেনিফিট পাবে না।
এই পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, এটা পূণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক সক্ষমতার যে কথা আসছে, আমার মনে হয় না এটা বড় ধরনের কোনো ইস্যু। কারণ, প্রকল্পটা অর্ধেক বাস্তবায়ন হলে হবে না, পরিপূর্ণভাবে করা দরকার। এছাড়াও ক্যানেলগুলো পুনরুদ্ধার করা দরকার। এগুলো যদি নালার পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় তাহলে বেনিফিট পাবেন না।
রাজউকের সক্ষমতা নিয়ে উঠা প্রশ্নের বিষয়ে আকতার মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যেকটা সরকারি অফিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাজউক এর ব্যতিক্রম না। রাজউকের অধিভুক্ত যে এলাকা, সেখানে যদি তাদের সেবা দিতে হয়, সেখানে প্রচুর লোক লাগবে। সেখানে পরিকল্পনাবিদ থেকে শুরু করে স্থপতি, প্রকৌশলীসহ সকল ধরনের পেশাজীবী লাগবে। এই উত্তরণের জন্য তাদের যে অগ্রানোগ্রাম আছে, তা অনুযায়ী লোক নাই। যে যে জায়গায় লোকের ঘাটতি আছে, তাদের নিয়োগ করা প্রয়োজন। এছাড়াও নতুন করে অ্যাসেসেমেন্ট করার দরকার আছে। কারণ, প্রতিনিয়ত ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে।
এদিকে, হাতিরঝিল প্রকল্পের এরিয়া ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড বিল্ডিং ডিজাইন প্রকল্প নকশার সঙ্গে জড়িত স্থপতি ইকবাল হাবিব ঢাকা মেইলকে বলেন, রাজধানী হিসেবে ঢাকা পাওয়া পর থেকে এর পরিকল্পনা বলতে ১৯৫৯-৬০ সালের একটি পরিকল্পনা আমরা পাই। কিন্তু রাজধানী হওয়ার পর আশির দশক থেকে বলা যায় দ্রুত নগরায়ণ শুরু হয়, সেটা অপরিকল্পিত।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক ও কেন্দ্রীভূত সরকার হওয়ায় রাজধানী ঢাকা সরকার পরিচালনা থেকে শুরু করে দেশের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সবকিছুরই কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় জানিয়ে এই স্থপতি বলেন, ১৯৫৯-৬০ সালের যে মাস্টার প্ল্যান, সেখানে ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চল ও নদী, শহরের খাল, বিল-ঝিল এসব রেখেই উন্নয়ন অর্থাৎ এই শহরটির যে প্রাকৃতিক গঠন, সেটা বিবেচনায় নিয়ে একধরনের জলের সঙ্গে বসবাসের পরিকল্পনা ছিল।
সার্বিক বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন) এ.এস.এম রায়হানুল ফেরদৌস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা লেকের পানি নিয়মিত ওষুধ দিয়ে থাকি। ইতোমধ্যে ওষুধ দেওয়ার একটা প্রজেক্ট আমাদের শেষ হয়েছে। এছাড়াও বেশকিছু বিষয় নিয়ে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে। বিষয়গুলো আমাদের নজরে রয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা নেবো।’
উল্লেখ্য, হাতিরঝিলের আওতায় নির্মিত ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেস রোড, ৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার সার্ভিস রোড, চারটি সেতু, চারটি ওভারপাস, তিনটি ভায়াডাক্ট ও দুটি ইউলুপ রয়েছে। ২০০৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) হাতিরঝিল প্রকল্প অনুমোদন দেয়। প্রকল্পে ব্যয়ের এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজউকের এক হাজার ১১৩ কোটি সাত লাখ, এলজিইডির ২৭৬ কোটি এবং ঢাকা ওয়াসার ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা রয়েছে।
পরবর্তীকালে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন এবং তদারকি করে এসডব্লিউও।
ডিএইচডি/আইএইচ