রোববার, ৫ মে, ২০২৪, ঢাকা

পুরান ঢাকায় ৫ টাকায় নবাবি গোসল

এস. এম. শাহাদাত হোসেন অনু, জবি প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

পুরান ঢাকায় ৫ টাকায় নবাবি গোসল

‘পুকুরটা নবাব পরিবারের ছিল। নওয়াব আলিমুল্লাহ সাহেব জায়গা কিনে নিয়ে এখানে পুকুর বানাইছে। উনি এখানে মাছ ধরতেন। এই পুকুরের ইতিহাস অনেক আগের। বিতর্কও রয়েছে অনেক। এই পুকুর নিয়ে নবাব পরিবারের বংশধরদের মধ্যে মামলাও চলে, পরে সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশে মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পুকুরটির বৈধ মালিকানা পায়। এই ট্রাস্ট আবার নবাববাড়ি ট্যাংক কমিটি করেন। এই ট্যাংক কমিটিই বর্তমানে পুকুরটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।’

পুরান ঢাকার ইসলামপুরের নবাববাড়ি মার্কেট রোড সংলগ্ন ও আহসান মঞ্জিলের পেছনে অবস্থিত ‘নবাববাড়ি’ পুকুর। এর ইতিহাস এভাবেই বলছিলেন নবাববাড়ি ট্যাংক কমিটির সভাপতি মো. কাইয়ুম। 


বিজ্ঞাপন


বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর পুরান ঢাকা। মানুষের কোলাহলের এই শহরের পুকুরে ডুব দিয়ে স্বস্তির গোসল করতে মরিয়া হয়ে থাকেন খান্দানি ঢাকাবাসী। সেই স্বস্তির গোসল করতে মানুষের চাহিদা পূরণ করে আসছে পুরান ঢাকার ইসলামপুরস্থ নবাবদের এই পুকুর। সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে ৫ টাকা দিয়ে এই পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে গোসল ও সাঁতার কেটে স্বস্তি পান এলাকাবাসী।

dhaka-1

বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গোল আকৃতির এই পুকুরটির চারপাশ ওয়াল দিয়ে ঘেরা। পুকুরের চারদিকে রয়েছে বিশাল আকৃতির নারিকেল গাছ। পুকুরের ঘাটে ৫ টাকা জমা দিয়ে গোসল করছেন অনেক মানুষ। যুবক বয়সী ছেলেরা দল বেঁধে সাঁতার কাটছেন। গোসল করতে আসা ছাড়াও পুকুরটি দেখার জন্য দর্শনার্থীও আসতে দেখা যায়। এছাড়াও পুকুরের পাড়ে রুমের ভেতর রয়েছে ওয়াসার পানিতে জামা কাপড় ধোঁয়া ও গোসলের ব্যবস্থা। যাদের পুকুরে পানিতে নামতে ভয় তারা পুকুর পাড়েই ওয়াসার পানিতে গোসল করছেন।

মো. কাইয়ুম বলেন, আমাদের ট্রাস্টে ১১ জনের একটা কমিটি আছে। সেখান থেকে নির্বাচন দিয়ে নবাববাড়ি ট্যাংক কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। আগে এখানে গোসল করার জন্য ২ টাকা করে নেওয়া হতো, গত চার বছর যাবত আমরা পুকুরের পরিচর্যার জন্য ৫ টাকা করে নেই। আমাদের পুকুর রক্ষণাবেক্ষণে ৪ জন স্টাফ আছে, চারদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে।


বিজ্ঞাপন


তিনি বলেন, এখানে গোসল করতে বাহির থেকেও দর্শনার্থী আসে। বেশিরভাগ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাপড় নিতে এসে এখানে গোসল করে যায়। এখানে গোসল করতে মহিলারাও আসে, তাদের জন্য আলাদা কাপড় চেনজ করার ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও এখানে হিন্দুদের বিয়ের হলুদ হয়। তারা ব্র্যান্ড পার্টি নিয়ে এসে কলস দিয়ে পানি নিয়ে যায়। বিয়ের হলুদের জন্য কোনো চার্জ নেওয়া হয় না।

dhaka-3

কাইয়ুম আরও বলেন, এখানে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার খেলা হয়। যারা ইচ্ছে করে এখানে মাছ ধরতে আসতে পারে। মাছ ধরার জন্য আলাদা চার্জ দিতে হয়। কারণ আমরা মাছের জন্য এখানে আলাদা খরচ করি। এই পুকুরের সাথে ঢাকার কোনো ড্রেনের বা ড্রাস্টবিন লাইনের সংযোগ নেই। পানি সবসময় পরিষ্কার রাখা হয়। বৃষ্টিতে পানি বেশি হলে নিষ্কাশন করা হয়। মাঝে মাঝে পানির সংকট থাকলে ওয়াসার পানি দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে পুকুরের চারপাশে পার্কের সুবিধা করা হবে মানুষ যেন হাঁটতে পারেন, এসে আড্ডা দিতে পারেন।

পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা এরশাদ মিয়া বলেন, এই পুকুর ছিল নবাবি আমলের পুকুর। আমাদের বাপ-চাচারা এখানে গোসল করতেন। এলাকায় এই একটি মাত্র পুকুর। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটা, ডুব দিয়ে গোসল করার মজাই অন্যরকম। অবসর পেলে প্রায় প্রতি সপ্তাহে এখানে এসে গোসল করি। 

তীব্র তাপদাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে সকল কার্যক্রম থাকায় বন্ধুদের নিয়ে গোসল করতে এসেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী শরীফুল ইসলাম শ্রাবণ। তিনি বলেন, অনেকদিন ধরে ঢাকায় থাকি, গ্রামের বাড়ির পুকুরে গোসল করাকে অনেক মিস করি। তাই আজকে বন্ধের দিনে এখানে গোসল করতে এসেছি। এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। এখন থেকে সুযোগ পেলেই এখানে আসব।

পুকুর পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, এই পুকুরে বেশিরভাগ ইসলামপুর, বাংলাবাজার, বাদামতলী, বাবুবাজার, শাঁখারীবাজার, পাটুয়াটুলী, তাঁতীবাজার, নয়াবাজার এলাকায় বিভিন্ন দোকান বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লোকজন বেশি গোসল করেন।

dhaka-2

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬১০ সালে নবাব আব্দুল বারি প্রথম এই পুকুরটি খনন করান। এরপর এখান থেকে পুরান ঢাকা কামার, কুমার ও মৃৎশিল্পীরা মাটি নিয়ে এটাকে আরও গভীর করেন। তাদের থেকে ১৮৩০ সালে নবাব খাজা আলিম উল্লাহ কুঠিসহ জলাশয়টি কিনে নেন। এরপর জলাশয়টি সংস্কার করে পুকুরে পরিণত করা হয়। বৃত্তাকারে প্রায় সাড়ে ছয় বিঘা জমির ওপর তৈরি হয় পুকুর। স্বাধীনতার পরপর পুকুরের সৌন্দর্য হ্রাস পায় এবং এটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এছাড়া পুকুরের মালিকানাকে কেন্দ্র করে নবাব পরিবারের বংশধরদের মধ্যে মামলা-আপসের কারণেও পুকুরটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পুকুরটির বৈধ মালিকানা পায়।

আগে একে ‘গোল তালাব’ নামে ডাকা হতো। তালাব উর্দু শব্দ, যার অর্থ জলাধার। পরে এটি নবাববাড়ির পুকুর নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পায়। আর সরকারি গেজেটে এর নাম ‘ইসলামপুরের গোল তালাব’ তবে স্থানীয়রা এই পুকুরটিকে ‘নবাববাড়ি পুশকুনি’ নামে সম্বোধন করেন। বর্তমানে ‘মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট’ পুকুরটির দেখাশোনা করছে।

শত ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে উনিশ শতকে খনন করা পুকুরটি আজও টিকে আছে গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।

প্রতিবেদক/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর