রোববার, ৫ মে, ২০২৪, ঢাকা

দুর্যোগে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বাংলাদেশে

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

দুর্যোগে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বাংলাদেশে

প্রচণ্ড গরমে হাঁস-ফাঁস করছে জনজীবন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চলে দিনের বেলায় রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। স্কুল-কলেজ সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। আদালতে আইনজীবীদের কালো গাউন পরে আসার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলোকে রাখা হয়েছে সতর্ক অবস্থায়।

বেসরকারি একটি সংস্থার হিসেব মতে, ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল— এই পাঁচ দিনে হিট স্ট্রোকের উপসর্গ নিয়ে সারা দেশে মারা গেছে কম পক্ষে ৩৪ জন। সংখ্যাটা গত বছরের এপ্রিল-জুন তিন মাসে একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের চেয়ে অন্তত ১০ জন বেশি।


বিজ্ঞাপন


আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকেও নেই কোনো সুখবর। বুধবার আরও ৭২ ঘণ্টার হিট এলার্ট জারি করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিকুল নেওয়াজ জানিয়েছেন, এই তাপদাহ চলতে পারে আরও কিছুদিন। নির্দিষ্ট করে বললে অন্তত এপ্রিলের শেষ নাগাদ।

ঢাকা শহরের তাপমাত্রার রেকর্ড ইতিমধ্যে কয়েক দশকের বছরের হিসেব ছাড়িয়ে গেছে। দেশের অন্যান্য স্থানে যদিও তাপমাত্রা এখনও কোনো রেকর্ড ছাড়ায়নি, বাতাসে জলীয় বাস্পের আধিক্যের কারণে তাপানুভূতি অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় যথেষ্ট তীব্র। সব মিলিয়ে এখন এমন এক ধরনের দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যার সাথে বাংলাদেশের মানুষ খুব একটা পরিচিত নয়।

প্রকৃতির এই রুদ্র রোষ থেকে বাঁচার বিশেষ কোনো উপায়ও কেউ বাতলে দিতে পারছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাছ লাগানোর একটা ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। এ ধরনের উদ্যেগে দীর্ঘমেয়াদে সাফল্য আসার সম্ভাবনা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ কিভাবে টিকে থাকবে সেই সমাধান কেউ দিতে পারছে না।

আবহাওয়া বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটেরোলিজক্যাল অর্গানাইজেশন মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে তাপদাহের এই তীব্রতার কারণ হিসেবে মূলত জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো। প্রতিবেদনে প্রাপ্ত উপসংহারকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ডব্লিউএমওর মহাসচিব সেলেস্তে সাউলো বলেছেন, খরা ও তাপপ্রবাহ থেকে শুরু করে বন্যা ও ঝড়ের মতো চরম পরিস্থিতির পাশাপাশি ২০২৩ সালে এই অঞ্চলের অনেক দেশ তাদের উষ্ণতম বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।


বিজ্ঞাপন


তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যা সমাজ, অর্থনীতি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে মানুষের জীবন ও পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও চরম আবহাওয়ার প্রভাব এশিয়াকে কিভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তার বিস্তারিত উল্লেখ করে প্রকাশ করা এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে দুঃখজনক একটা পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আবহাওয়া, জলবায়ু ও পানির কারণে এশিয়ায় ৩,৬১২টি দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে যাতে মারা গেছে ৯ লাখ ৮৪ হাজার ২৬৩ মানুষ এবং এসব দুর্যোগে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এই মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি হয়েছে বাংলাদেশে।

প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৭০ থেকে ২০২১— এই ৫০ বছরে এশিয়ায় সর্বাধিক ২৮১টি দুর্যোগে ৫ লাখ ২০ হাজার ৭৫৮ জন মানুষ মারা গেছে বাংলাদেশে। কেবল চলমান তাপপ্রবাহই নয়, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত আর সামুদ্রিক সুনামি বাদ দিলে কয়েক দশকে বাংলাদেশকে প্রায় সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগই মোকাবিলা করতে হয়েছে, এমনকি ভূমিকম্পও।

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা— এসব তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে ভারী বৃষ্টিপাত, ভূমিধস, বজ্রপাত, চরম শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র তাপদাহ, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামা। এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আবহাওয়াজনিত কারণে অন্তত ১২টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে একটি দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে।

যদিও এসব দুর্যোগে প্রাণহানি অতীতের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে বৈশ্বিক এই সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কথা উল্লেখ করেছে। গত এক দশকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সবচেয়ে শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আঘাত হানে গত বছর ১৪ মে, যাতে দুই দেশ মিলিয়ে মারা গেছে ১৫৬ জন মানুষ। কাছাকাছি অঞ্চলে ২০০৮ সালে আঘাত হানা একই ধরনের ঘূর্ণিঝড় নার্গিসে মারা গেছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৬ জন মানুষ।

দুর্যোগে প্রাণহানি কমার কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর মাহবুবা নাসরীন বৈশ্বিক মনোযোগ ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ এবং সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধিকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। ‘২০০৪-০৫ সাল থেকে আমাদের দুর্যোগগুলো যখন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আমরা বুঝতে পারি প্রকৃতিই সব নয়। মানুষের হাত আছে। তখন থেকে আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করি এবং মৃত্যু কমতে শুরু করে, পাঁচ ডিজিট থেকে কমে তিন, দুই, এক ডিজিটে নেমে আসে মৃত্যু’, বলেছেন তিনি।

তবে মৃত্যুর এই সংখ্যা দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা পরিমাপের ঘোরতর বিরোধী লেখক, গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থানকেও দেশের অব্যাহত প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।

‘আমাদের দেশে যদি বৃষ্টিপাত না-ও হয় তবু বন্যা হতে পারে, কারণ ৯৩ শতাংশ নদীর উৎস অন্য দেশে,’ বলেছেন তিনি। ভৌগোলিক কারণের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেও ক্ষয়ক্ষতির একটা কারণ মনে করেন তিনি। ‘দুর্যোগকে আমরা মাপি লাশ দিয়ে, ডেড বডি দিয়ে। তো, ডেড বডি দিয়ে দুর্যোগ মাপা একটা সনাতন পদ্ধতি। কোনো লোক মারা না গেলেও দুর্যোগ বড় হতে পারে। অনেকে মারা গেলে বড় দুর্ঘটনা। যদি কেউ না মারা যায় তাহলে ছোট দুর্ঘটনা— এটা একটা ভুল পরিমাপের বিষয়। এটা নিয়ে আমরা যত আলোচনা করব ততই কিন্তু আমরা বিপাকে পড়ে যাব। দুর্যোগকে বুঝতে পারব না।’

ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষয়ক্ষতির সুদূর প্রসারী প্রভাবই একটা দুর্যোগের ভয়াবহতা মাপার মানদণ্ড হওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক। উদাহরণ হিসেবে তিনি চলমান তাপপ্রবাহকেই উল্লেখ করেছেন। সরকারি হিসেবে চলমান এই তাপপ্রবাহে বুধবার পর্যন্ত মৃত্যু চারজন। কিন্তু এর ক্ষয়ক্ষতি সুদূর প্রসারী। ‘হয়তো আর কিছুদিন পরে এটা থাকবে না, চলে যাবে। ক্ষতিটা সেভাবে আমলে নেওয়া হবে না। কিন্তু এমন মানুষ আছে যারা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেটা আমরা চিন্তায়ও আনছি না। পোল্ট্রি খামারি আছে, ছোট ছোট হ্যাচারি আছে— এরা সারা জীবনের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে।’

অনেক পোল্ট্রি খামারিই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই তাপপ্রবাহ তাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অনেক খামারেই মুরগি মরে যাচ্ছে। কেউ কম দামে মুরগি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ডিমের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। তাপের কারণে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাছ মরে যাচ্ছে। বোরো ধান, আম এবং লিচুর উৎপাদনও কম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্য অনেক। দেশের একটা অংশের মানুষের কাছে তাই চলমান এই তাপপ্রবাহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয়েছে।

এসব দুর্যোগের জন্য প্রকৃতিকেই কেবল দায়ী করে যাওয়া প্রায় কোনো দুর্যোগ বিশেষজ্ঞই আর সমর্থন করছেন না। প্রায় প্রতিটি দুর্যোগের পেছনেই তারা মানুষের ভূমিকা দেখছেন। নদীর গতিপথ পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে অবিরাম কার্বন নিঃসরণ, নির্বিচার বন উজাড়সহ অপরিকল্পিত নগরায়ন ইত্যাদি অনেক কিছুই প্রকৃতিকে রুষ্ট করে তুলছে।

‘সব দুর্যোগের পেছনেই মানুষের বড় হাত আছে। গরম পড়ছে আর গরম লাগছে— দুটোর মধ্যে তফাৎ আছে। ঢাকা শহরের মধ্যে দুই জায়গায় দুই রকম তাপমাত্রা। মানুষ এটা তৈরি করেছে,’ বলেছেন গওহার নঈম ওয়ারা। আমার অবদানটা আমি দেখব না, শুধু প্রকুতিকে দোষ দেব— এ ধরনের মনোবৃত্তির কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর