শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে যা বলছে সরকার

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে যা বলছে সরকার
ফাইল ছবি

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলছে— গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০২২ সালের মতোই বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও নির্যাতন হয়েছে। এসব ঘটনায় দায়ীদের শনাক্ত করে শাস্তি দেয়নি সরকার। বরং উল্টো ‘ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়েছে। 

যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে ক্ষমতাসীন দল বলছে— ‘মনগড়া’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। 


বিজ্ঞাপন


কী আছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে?
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে সংগঠিত ঘটনাগুলোর মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে বেআইনি হত্যা, গুম, সরকারের নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, নির্বিচারে গ্রেফতার-আটক, অমানবিক ও অসম্মানজনক আচরণ, কারাগারের কঠিন ও জীবনের জন্য হুমকির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অন্য দেশে থাকা ব্যক্তিদের ওপর নিপীড়ন চালানোর তথ্যও রয়েছে। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিগত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। 

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে আটজনের। তবে অন্য একটি মানবাধিকার সংগঠন একই সময়ে ১২ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যার খবর দিয়েছে। 

স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২ জন গুম হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী। মার্কিন প্রতিবেদন মতে— এসব ঘটনা প্রতিরোধ, তদন্ত বা দোষী ব্যক্তিদের সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার সামান্যই চেষ্টা করেছে। 


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ব্যক্তির গোপনীয়তার ক্ষেত্রে নির্বিচারে বেআইনি হস্তক্ষেপ চালানো হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ব্যক্তির অপরাধের শাস্তি স্বজনদের দেওয়ার কথাও। 

গণমাধ্যম ও বাক-স্বাধীনতার বিষয়ে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের মতো গতবছরও মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, অহেতুক গ্রেফতার বা বিচার, সেন্সরশিপ এবং ইন্টারেনেটে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুতর বিধিনিষেধ আরোপ অব্যাহত ছিল।

প্রতিবেদন মতে— দেশে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ চালানো এবং চলাফেরার স্বাধীনতায় নানান বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বেসরকারি ও নাগরিক সংগঠনগুলো পরিচালনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিধিনিষেধমূলক আইন চালু করা হয়েছে। বিশেষ করে— জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডে সরকারের পক্ষ থেকে গুরুতর বিধিনিষেধ আরোপ করে হয়রানি করা হচ্ছে। 

নির্বাচন নিয়ে মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা বাংলাদেশের নাগরিকদের হাতে নেই। 

২০২৩ সালে হওয়া দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হলে তাদের সাজা দেওয়ার সুযোগ আইনে রয়েছে। কিন্তু সরকার সেই আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। ফলে দুর্নীতি করেও সেটির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা প্রায়শ দায়মুক্তি পেয়েছেন। 

এছাড়া লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, বিশেষত- পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, যৌন নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, শিশুশ্রম, শিশু–বাল্যবিবাহ, জোরপূর্বক বিয়ে, জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যকার সম্মতিপূর্ণ সমলিঙ্গের যৌন আচরণকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা, স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন ও কর্মীদের সংগঠন করার স্বাধীনতার ওপর উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সরকার কী বলছে?
যদিও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি সরকার। তবে প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা।  

তাদেরই একজন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, এটি একটি মনগড়া রিপোর্ট এবং এখানে সত্যের হার খুবই কম। বাংলাদেশ নিয়ে তারা প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগ তোলে, যার বেশির ভাগই অসত্য। তাদের কাছে এসব অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ চাওয়া হবে।

প্রতিবেদন প্রকাশের আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়ার সমালোচনা করে নাছিম বলেছেন, অভিযোগগুলোর পক্ষে তাদের কাছে যদি তথ্য-প্রমাণ থেকে থাকে, তাহলে তারা বাংলাদেশ সরকারকে সেটি জানাননি কেন, তাদের তো উচিত ছিল সরকারের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানানো এবং সমস্যা সমাধানে সাহায্য করা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, তাদের ওখানের পরিস্থিতি কি খুব ভালো। প্রায়ই তো শোনা যায় পুলিশের গুলি ও নির্যাতনে মানুষ মারা যাচ্ছে। আবার অনেকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে, বর্ণবাদী সহিংসতা হচ্ছে। 

আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আশা প্রকাশ করেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন নিয়ে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানাবে। 

কোনো প্রভাব পড়বে?
প্রতিবেদনে উঠে আসা মানবাধিকার পরিস্থিতি দেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন— মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। 

হুমায়ুন কবির একজন বিশ্লেষক। বাংলাদেশের সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, তাদের এই প্রতিবেদনকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গুরুত্ব সহকারে দেখে। কাজেই বহির্বিশ্বের কাছে একটি দেশের ভাবমূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। 

দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন চিত্র দেখার পর বিদেশি বড় বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহ নাও দেখাতে পারেন। এছাড়া প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগ আমলে না নিলে ভবিষ্যতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। 

হুমায়ুন কবির বলেন, এই প্রতিবেদনকে একটি সিগনাল হিসেবে দেখা যেতে পারে। এটি আমলে না নিলে দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন সময় আরোপ করে থাকে। 

২০২১ সালে র‍্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির বলেন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বিশেষ এই বাহিনী ও তার ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

রানাপ্লাজা ধ্বসের ঘটনার পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশি পণ্যের অবাধ বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। হুমায়ুন কবির বলেন, গুরুত্ব সহকারে নিয়ে এ বিষয়ে এখনই কাজ শুরু না করলে সামনে এ রকম নিষেধাজ্ঞা হয়তো আরও আসতে পারে। 

যদিও বিষয়টি নিয়ে সরকার খুব একটা চিন্তিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি এতটা খারাপ না যে নিষেধাজ্ঞা আসবে। এমন নিষেধাজ্ঞার কথা আমরা আগেও অনেকবার শুনেছি এবং দেখা গেছে, সরকারবিরোধীরাই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেগুলো ছড়িয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর