রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

ঈদ এলে আতঙ্ক বাড়ে

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৮ পিএম

শেয়ার করুন:

একাত্তর টিভির গাড়িতে ছিনতাই

গত শনিবার রাত ১০টার দিকে কাঁটাবন রোড ধরে রিকশাযোগে ঢাকেশ্বরীতে নিজ বাসার দিকে ‍যাচ্ছিলেন জুনায়েদ শাহ। ওই সময় তিনি ফোনে কথা বলছিলেন। তাকে বহনকারী রিকশার পেছনে একটি মোটরসাইকেল আসে এবং তার হাতে থাকা মোবাইলটি মোটরসাইকেলে থাকা দুই যুবকের একজন টান দেন। এসময় জুনায়েদ শাহ রিকশা থেকে পড়ে যান এবং তার একটি হাত ভেঙে যায়। হাতে থাকা মোবাইলটি দ্রুত নিয়ে ছিনতাইকারীরা বুয়েট ক্যাম্পাসের দিকে চলে যান। তবে ওই সময় তার পেছনে আরেকটি মোটরসাইকেল চালক এ দৃশ্য দেখে ছিনতাইকারীদের ধাওয়া দেন। কিন্তু তাদের ধরতে পারেনি। 

আর এই ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ের পাশে থাকা নিউমার্কেট থানার সামনে। একটি থানার সামনে এমন ঘটনার শিকার হওয়ায় ভুক্তভোগী জুনায়েদ শাহ বেশ হতবাক।


বিজ্ঞাপন


তিনি ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, থানার সামনে এমন ঘটনা ঘটবে কল্পনায়ও ছিল না। ওই সময় রায়হান নামে একজন পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়। তবে হাতের অবস্থা ভালো ছিল না বলে দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। পরে পুলিশ বিষয়টি জানতে খোঁজ নেয়। এরপর সেই ছিনতাইকারীরা গ্রেফতার বা আটক হয়েছেন কিনা জানি না।

তিনি আরও জানান, মোটরসাইকেলে থাকা দুই ছিনতাইকারীকে তার পেছনে থাকা আরেক মোটরসাইকেল আরোহী এক যুবক ফলো করে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। এ যুবকও ঘটনার বর্ণনা দেন পুলিশের কাছে।

অন্যদিকে চলতি সপ্তাহে কারওয়ান বাজার থেকে হেঁটে অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন আতিকুর রহমান অনন্ত। পথে বাংলামোটর মোড় পার হতেই ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে যান। অস্ত্র দেখিয়ে তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি।

অনন্ত একজন সংবাদকর্মী। অন্যদিকে জুনায়েদ শাহ একজন ব্যবসায়ী। শুধু ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকরাই নয়, ঢাকায় পুলিশও ছিনতাইয়ের শিকার হন। তাদের হাতে প্রাণ হারান। এমন ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীতে। 


বিজ্ঞাপন


গত বছর ১ জুলাই ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিন ঘটে যায় এমনই একটি ঘটনা। শেরপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে ঈদের ছুটি শেষ করে ঢাকায় ফিরছিলেন পুলিশ সদস্য মনিরুজ্জামান। বাস থেকে নেমে রাজধানীর ফার্মগেট হয়ে যেখানে থাকেন সেখানে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথে ছিনতাইকারী ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় তার। কর্মস্থলে ফেরা হয়নি মনিরুজ্জামানের।

এর আগের বছর, ২০২২ সালে ঈদুল ফিতরে রাজধানীর কাজীপাড়া এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে দন্ত চিকিৎসক ডা. আহমেদ মাহী বুলবুল নিহত হন। তিনি ঈদের দিন ভোরে তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী যাওয়ার উদ্দেশে মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়া বাসা থেকে বের হন। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, ডা. বুলবুলের সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ও ব্যাগ ছিনিয়ে নিতেই তাকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা।

এবার ঈদের আগের দিন একটি ব্যাংক বুথে কর্মরত নিরাপদ কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা ও একটি টিভি চ্যানেলের গাড়িতে হামলা চালিয়ে ছিনতাই লুটের ঘটনা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

বুধবার ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে রাজধানীর গুলশান থানার শাহজাদপুর এলাকায় মধুমতি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তা কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত নিরাপত্তা কর্মীর নাম হাসান মাহমুদকে (৫৫)। এ ঘটনায় এখনো কাউকে শনাক্ত করে আটক বা গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এর আগেও এটিএম ব্যাংকের বুথের নিরাপত্তা কর্মীকে গলাকেটে হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। তবে এবারের বিষয়টি একেবারে ভিন্ন। হত্যাকারীরা তাকে হত্যার পর ব্যাংক বুথের টাকা লুটের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় বলে দাবি পুলিশের।

1

একই দিন ভোর রাত তিনটায় বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তর টিভির দুটি গাড়িতে হামলার পর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার রাত পৌনে ৩টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেল ক্রসিং এলাকায় রেলক্রসিং সিগন্যালে এ ঘটনা ঘটে।

একাত্তর টিভির সিনিয়র রিপোর্টার নাদির পারভেজ জানান, তাদের রাতের টিমের একটি গাড়ী কারওয়ান বাজার হয়ে হাতিরঝিল যাচ্ছিল। পথে তারা কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ে দাঁড়ায়। এসময় ছিনতাইকারীরা এসে গাড়িটি ঘিরে ধরে। পাশাপাশি তারা হামলা চালায়। হামলার পর গাড়িতে থাকা তিনজনের নগদ টাকা ও পরিবারের জন্য কেনা ঈদের নতুন পোশাক নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। খবর পেয়ে একাত্তর টিভির রিপোর্টার ইশতিয়াক ইমন ক্যামেরাম্যানসহ ঘটনাস্থলে গেলে তার উপরেও হামলা চালায় তারা।

ছিনতাই ও ছিনতাইকারীদের হামলার শিকার রিপোর্টার ইশতিয়াক ইমন বলেন, আমি নাইট ডিউটিতে ছিলাম। ছিনতাইয়ের খবর পেয়ে ক্যামেরাম্যানসহ ঘটনাস্থলে যাই। এসময় ছিনতাইকারীরা সংঘবদ্ধভাবে আমাদেরকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে ক্যামেরাম্যান খোরশেদ আলমকে জিম্মি করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ছিনতাইকারীরা। এসময় উপর্যুপরি কিল-ঘুসি মেরে তাকে জখম করা হয়।

প্রতি বছর ঈদের মৌসুম এলেই আতঙ্ক বাড়ে। আতঙ্ক বাড়ে রাতের আঁধারে নিরাপদে ঘরে পৌঁছানো যাবে কিনা। কারণ পথে ছিনতাই আর ঘরে চুরির ভয়। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিবারই দাবি করা হয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে কিন্তু দেখা যায় ঘটে যায় তার উল্টোটা। তখন তারা সক্রিয় হয়ে ওঠেন সেই অপরাধীদের ধরতে। আবারও একই ঘটনা ঘটতে থাকে।

তবে প্রতি ঈদের আগে ও পরে আতঙ্কটা বেশি বাড়ে। বিশেষ করে ঈদের আগে ঢাকার বুকে ছিনতাইকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তারা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নেন। আবার কেউ কেউ মোটরসাইকেলে চলন্ত অবস্থায় ছিনতাই করে পালিয়ে যান। তবে এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে চান না। কারণ তারা মনে করেন, অভিযোগ করলে উল্টো হয়রানি হতে হয় তাদের। 

এবার ঈদের ছুটি শুরু হওয়া আগেই বাসাবাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার রাজধানীর তেজগাঁও তেজকুনি পাড়া কমিশান গলির ১৪৬ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় দুই লাখ টাকা ও স্বর্ণলংকার চুরি হয়েছে। 

ভুক্তভোগী রিজভী জানান, তিনি ঘটনার রাতে তারাবির নামাজে গিয়েছিলেন ফেরত এসে দেখেন ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো। পরে আলমারি খুলে দেখে নগদ দুই লাখ টাকা, প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণলংকার চুরি করে নিয়ে গেছে। তবে রাত গভীর হওয়ার আগে এমন চুরিতে তিনি হতবাক। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে প্রতিবছর ছিনতাই রোধে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু দেখা যায় এসব অপরাধীরা জেল থেকে জামিন বেরিয়ে আবারও একই কাজ করে। ফলে ছিনতাই কোনোভাবে রোধ করা যাচ্ছে না। ছিনতাই ছাড়াও রাজধানী ঢাকা ছাড়লে আরেক বিপত্তি বাধে। আর সেটি হলো চুরির ভয়। গত কয়েক বছরে ঈদের আগে পরে মিলে বেশ কিছু চুরির ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনাগুলোর পরে সেভাবে চোর শনাক্ত হয়নি। যদিও ডিএমপির পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে চোর ধরতে অভিযান চালানো হয়।

ডিএমপির তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে কয়েক হাজার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ১ হাজার। তবে চুরির ঘটনায় মামলার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। 

গেল বছরে ছিনতাইয়ে ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৯৯টি, চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫১১টি। ২০২২ সালে ছিনতাই মামলা ৩১০টি এবং চুরির মামলা ১ হাজার ৬০৩টি। তারও দুই বছর আগে ছিনতাই মামলা হয় ১৬৬টি এবং চুরি সংক্রান্ত মামলা হয় ১ হাজার ৩৪৩টি। ২০২০ সালে ছিনতাই মামলা ১৭৬টি এবং চুরির মামলা ১ হাজার ২১৭টি।

রাজনীতি প্রতিনিয়ত ঈদের আগে ও পরে নানা ঘটনা ঘটলেও বরাবরই তা নিয়ন্ত্রণে আছে বলে পুলিশ দাবি করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমানের দাবি, সম্প্রতি ছিনতাইয়ের ঘটনা কমেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে ছিনতাইয়ের ঘটনা কিছুটা কমেছে। কিন্তু ঈদকে ঘিরে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে কারণে চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধ ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাওয়া মানুষজনকে তাদের বাসার দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন কমিশনার।

পুলিশ বলছে, ঢাকায় যারা ছিনতাই করে তাদের অনেকগুলো স্পট আছে। তার মধ্যে ফার্মগেট, গাবতলী, আসাদগেট এছাড়াও সদরঘাট, সায়দাবাদ। তবে এই স্পটগুলোতে তারা দিনে দুপুরে ছিনতাই করে। যারা দিনে ছিনতাই করে তাদেরকে অভিযান চালিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করে। এখনো সেই গ্রেফতার কার্যক্রম অব্যাহত আছে। 

তবে ঢাকার ছিনতাইকারীদের নিয়ে পুলিশ পর্যালোচনা করেছে কারা কখন কেন এসব ছিনতাই করে। পুলিশের জরিপ বলছে, ঢাকায় দুই ধরনের ছিনতাইকারী রয়েছে। একটি অপেশাদার আরেকটি পেশাদার। যারা দিনের বেলা প্রকাশ্যে ছিনতাই করে তাদের অধিকাংশ নেশাখোর ও ভাসমান। নেশাখোর হওয়ায় তাদের যখন নেশা ওঠে তখন তারা ছিনতাই করে। আবার আরেকটি গ্রুপ আছে যারা পেশাদার অপরাধী/ছিনতাইকারী। 

পুলিশ ঈদের আগে পরে নগরবাসী নিরাপত্তায় কেমন ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের ডিসি ফারুক হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে ডিএমপি প্রত্যেকটি থানায় প্রতিরোধ টিম আছে। এসব টিম ঈদকে সামনে রেখে একযোগে কাজ করছে। তবে ছিনতাইকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারছে না পুলিশের তৎপরতার কারণে বলে দাবি করেন তিনি। 

তিনি আরও বলেন, আমরা যাদেরকে গ্রেফতার করছি দেখা যাচ্ছে তাদের এক একজনের নামে ২০ থেকে ২৫টি মামলা। আসলে তারা পেশাদার ছিনতাইকারী। আমরা ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করছি কিন্তু তারা আবার জামিন পেয়ে যাচ্ছে। বের হয়ে তারা আবার একই পেশায় সংযুক্ত হয়। ছিনতাইকারীরা যাতে জামিন না পেতে পারে সেটার জন্যও আমরা পেশাগতভাবে কাজ করে থাকি। ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারের ফলে ঢাকা শহরে এই মুহূর্তে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেন ফারুক হোসেন।

ঈদের আগে ও পরে ছিনতাইকারীরা যাতে সক্রিয় হয়ে উঠতে না পারে এজন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রতিটি থানাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। থানা পুলিশের সদস্যরা এই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন।

এমআইকে/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর