রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

এবারও সক্রিয় জাল টাকা তৈরি চক্র, পাল্টেছে কৌশল

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৯ পিএম

শেয়ার করুন:

এবারও সক্রিয় জাল টাকা তৈরি চক্র, পাল্টেছে কৌশল
বিভিন্ন সময় জাল টাকা উদ্ধার হলেও মূল হোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবার ঈদ ও পূজা-পার্বনকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকা তৈরি চক্র৷ আগে তারা ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে বসে জাল টাকা তৈরির পর তা ঢাকায় নিয়ে আসত। এরপর ঢাকা থেকে তা ছড়িয়ে দেওয়া হতো বিভিন্ন জেলার হাট-বাজারে। গত কয়েক দশক থেকে এমনটি করে এলেও এবার তারা কৌশল পাল্টেছে৷ ঢাকা ছেড়ে বাইরের জেলাগুলোতে আস্তানা গেড়ে সেখানে চলছে জাল টাকা তৈরির কাজ। কারখানাগুলো দুর্গম এলাকায় হওয়ায় তথ্য পেলেও অভিযান চালিয়ে সফল হতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার দুর্গম একটি এলাকায় এমন কারখানার সন্ধান পেয়ে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় তিনজনকে। এসময় তাদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা, জাল নোট তৈরিতে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, প্রিন্টার ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়। সেই সাথে এ ঘটনায় মূল হোতা আরিফ ব্যাপারীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। যার বয়স মাত্র ২২ বছর।


বিজ্ঞাপন


র‌্যাব জানায়, আরিফ একটি কম্পিউটার দোকানে কাজ করতেন। সেখানে ইউটিউব চ্যানেলে জাল টাকা তৈরির ভিডিও দেখতে পান। এরপর জাহিদ ও অনিক নামে দুজনকে সাথে নিয়ে জাল টাকা তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি।

আরও পড়ুন

ইউটিউব দেখে জাল টাকা তৈরি শিখেন জিসান

আরিফ তার তৈরি জাল টাকা প্রতি লাখে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। আর ঈদ বা বিভিন্ন উৎসবে প্রতি লাখে পেতেন ১৫ হাজার। এই জাল টাকা বিক্রির জন্য আরিফ তার সহযোগীদের নিয়ে ফেসবুকে গ্রুপ খোলেন। তাদের ফেসবুক পেজে কেউ বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তাকে গ্রুপের সদস্য করা হতো। পরে তার সাথে চলত ফোনে যোগাযোগ। শেষে তার কাছে বিকাশে টাকা নিয়ে সেই জাল টাকা কুরিয়ারে আবার কখনো সরাসরি হাতে তুলে দিতেন তারা। এছাড়াও তারা হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ও ভাইভারে গ্রুপ খুলেও এই ব্যবসা চালাতেন। চক্রটি চট্টগ্রাম, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুরে এসব জাল টাকা জরবরাহ করত।

jaltaka2


বিজ্ঞাপন


র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক মহিউদ্দিন আরিফ ঢাকা মেইলকে বলেন, জাল টাকা তৈরির একটি চক্রকে আমরা ধরেছিলাম। তারা সেখানকার একটি জেলে পল্লীতে বসে সেগুলো তৈরি করত। কারণ সেখানে জেলে পল্লী হওয়ায় প্রচুর মাছ কেনাবেচা হতো এবং অনেকে নদীপথে ঢাকায় আসেন। সেই সুবাধে তারা এসব জাল টাকায় সহজে ঢাকায় পাঠাতে পারত।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, মূলত এই চক্রের দুই সদস্য এক সময় ফকিরাপুলে প্রিন্টিং প্রেসে চাকরি করতেন। তাদের কাছ থেকে প্রিন্টিংয়ের যাবতীয় বিষয় তারা শুনে এই কাজে নেমে পড়েন। তবে সবাইকে আমরা গ্রেফতার করেছি।

র‌্যাবের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঈদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বেশ কিছু জাল টাকা তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে তারা। খুব শিগগিরই অভিযানও চালানো হবে। তবে সেই কারখানাগুলোতে অভিযানের আগেই সটকে পড়ে মূল হোতারা। ফলে তাদের গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

গত কয়েক বছরে জাল টাকার মামলায় যাদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশির ভাগই সরবরাহকারী ও বিক্রয়কারী। কিন্তু আসল হোতারা থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখন সেই হোতাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চালাচ্ছে র‌্যাব ও পুলিশ।

আরও পড়ুন

অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে জাল টাকা বিক্রি

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, প্রতি ঈদে জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিরা ব্যাংক, বিমা, হাটবাজার, মার্কেট ছাড়াও সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েও এসব বিক্রি করে থাকে। তারা তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ নিয়ে লাখ টাকা তুলে দেয় চক্রের সদস্যদের হাতে। কখনো এই টাকা তারা ব্যাংকের বুথে টাকা সরবরাহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও ছড়াচ্ছে। আবার নিজেরাই হাটবাজারে ভিড়ের মাঝে কেনাকাটা করে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ঢাকা বাইরে আস্তানা গেড়েছে অনেক চক্র!

ডিবি বলছে, জাল টাকার সন্ধান মিললেও কারখানা মিলছে না। জাল টাকা পাওয়া গেলেও কারখানাগুলো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডিবি দেশের দুটি জেলায় জাল টাকার কারখানার সন্ধানও পেয়েছে। কিন্তু সেগুলো ঢাকা থেকে অনেক দূর হওয়ায় অভিযান চালানো কঠিন। কারণ জাল টাকা তৈরি চক্রের সদস্যরা খবর পাওয়া মাত্র ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে সব কিছু সরিয়ে ফেলে।

এ বিষয়ে ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা জাল টাকা তৈরি চক্রের সদস্য এবং যারা এগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের গ্রেফতার করছি। কিন্তু কারখানায় অভিযান চালানোর আগেই তারা টের পেয়ে সব কিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। ফলে কারখানায় হানা কঠিন হয়। সন্ধান মিললেও সেখান পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে খবর পেয়ে যাচ্ছে জাল টাকা তৈরি চক্রের সদস্যরা।’

Jal33

ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা ফেসবুকে এসব বিজ্ঞাপন দেন তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেন না। কারণ আমরা কেরানীগঞ্জ থেকে এক স্মার্ট যুবককে ধরেছিলাম, সে টাকা দেবে বলে অনেকের কাছে টাকা নিত, কিন্তু জাল টাকা দিতে পারত না।’

এদিকে ডিবির একটি সূত্র বলছে, যারা বিভিন্ন সময়ে জাল টাকা তৈরির মামলায় আসামি ছিল তারাই জামিনে বেরিয়ে আবারও এই কাজ করে। তবে তারা এখন ঢাকা ছেড়ে ঢাকার বাইরে আস্তানা গেড়েছে।

আরও পড়ুন

পুলিশ থেকে চাকরিচ্যুত হুমায়ুন এখন জাল টাকার কারবারি

এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি ফারুক হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঢাকায় জাল টাকা তৈরির একাধিক চক্র রয়েছে। আমরা প্রতি বছর দেখি ঈদ এবং কোরবানিকে কেন্দ্র করে জাল টাকা তৈরি করে চক্র বাজারে ছাড়ার জন্য চেষ্টা করে। পুলিশ এ বিষয়ের সতর্ক থাকে কোথাও জাল টাকা তৈরি হচ্ছে কি না। তথ্য পেলে আমরা তাদের গ্রেফতার করি। যারা জাল টাকা তৈরি করে তাদের পেছনে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা কাজ করছে। ঈদকে কেন্দ্র করে জাল টাকা যাতে মার্কেটে তারা ছড়াতে না পারে সেজন্য পুলিশের যাবতীয় কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশের ব্যাপক কার্যক্রমের কারণে তারা এখন ঢাকায় জাল টাকা তৈরি করে না। তারা এখন ঢাকার বাইরে অবস্থান নিয়েছে। তারা শরীয়তপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজার ও পঞ্চগড়ে বসে জাল টাকা তৈরি করে। এসব জাল টাকার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাদের আবার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। প্রতি লাখ জাল টাকা তারা কমিশনে বিক্রি করে। এরপর তাদের লোকজন সেই টাকাগুলো ঢাকায় এনে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা যে অনলাইনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জাল টাকা ছড়িয়ে থাকে এই অনলাইন প্লাটফর্মটি আমাদের সাইবার বিভাগের সদস্যরা মনিটরিং করছে। আমাদের যথেষ্ট মনিটরিংয়ের কারণে জাল টাকা কমে এসেছে।’

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর