সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাদক কারবার চালাচ্ছে বিদেশে বসেই!

কাজী রফিক
প্রকাশিত: ২০ মার্চ ২০২৪, ১০:১৮ পিএম

শেয়ার করুন:

সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাদক কারবার চালাচ্ছে বিদেশে বসেই!
ছবি: সানগ্লাস পড়া মোল্লা এরশাদ, শার্ট গায়ে চুয়া সেলিম

ষাট হাজার পিস ইয়াবাসহ ২০১৮ সালে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় পুলিশের হাতে আটক হন তিনজন। তাদের একজন মোল্লা এরশাদ। ঘটনা গড়ায় বহুদূর। বেরিয়ে আসে মোট ছয়জনের নাম। ২৭ দিন জেল খেটে জামিন পান তারা। আর জামিনে বের হয়েই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। 

দেশে না থাকলেও থেমে নেই মোল্লা এরশাদের ইয়াবা সাম্রাজ্য। দেশের বাইরে থেকেই চালাচ্ছেন ইয়াবার বিশাল নেটওয়ার্ক। আর তার এই নেটওয়ার্কে মূল হোতা সেলিম ওরফে চুয়া সেলিম। তিনি জেনেভা ক্যাম্পের অন্যতম শীর্ষ মাদক কারবারি। 


বিজ্ঞাপন


২০১৭ সালের মার্চে জেনেভা ক্যাম্পে চালানো হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক বড় অভিযান। এতে শতাধিক মাদক কারবারি গ্রেফতার হন। চিহ্নিত মাদক কারবারি ‘পঁচিশ’ র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়।

এ সময় জেনেভা ক্যাম্প ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান আরেক শীর্ষ মাদক কারবারি ইশতিয়াক। ২০১৯ সালে ভারতে মারা যান তিনি।

মোল্লা এরশাদ হাতেনাতে মাদক নিয়ে ধরা পড়লেও জেল খেটেছেন মাত্র ২৭ দিন। রায় ঘোষণার আগেই জামিন পান। আর জামিন পেয়েই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এই শীর্ষ মাদক কারবারি। বর্তমানে তিনি আছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

২০১৮ সালে মোল্লা এরশাদ যখন ৬০ হাজার পিস ইয়াবা ও দুটি গাড়িসহ আটক হন, ওই মামলার চার নম্বর আসামি ছিলেন ইশতিয়াক। মারা যাওয়ায় মামলার এজাহার থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়। 


বিজ্ঞাপন


এই মামলায় আসামি মোট ৬ জন। মাদক মামলায় তাদের প্রত্যেকেরই ১৪ বছরের সাজা হয়েছে। চলতি বছরের ২ এপ্রিল এ রায় আসে। জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের জন্য এখন পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ কারাবাসের সাজা।

তবে এ মামলার ছয়জন আসামির মধ্যে কারাগারে আছেন মাত্র তিনজন। তারা হলেন- পান্নু, গুড্ডু ও বাবর।

মামলার চার নম্বর আসামি ইশতিয়াক মারা গেছেন। পঞ্চম আসামি মোল্লা এরশাদ হাতেনাতে মাদক নিয়ে ধরা পড়লেও জেল খেটেছেন মাত্র ২৭ দিন। রায় ঘোষণার আগেই জামিন পান। আর জামিন পেয়েই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এই শীর্ষ মাদক কারবারি। বর্তমানে তিনি আছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। 

তবে তার নিয়ন্ত্রণেই আছে জেনেভা ক্যাম্পের লাখ লাখ টাকার মাদক কারবার।

জেনেভা ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ ইয়াবা বিক্রি হয়, তার অর্ধেকই মোল্লা এরশাদের নিয়ন্ত্রণে। নিজে না থাকলেও তার প্রতিনধি আছেন জেনেভা ক্যাম্পে। মোল্লা এরশাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত চুয়া সেলিম। ক্যাম্পের বি ব্লকের মসজিদের সামনে তার বাসা। তবে এখন আর সে বাসায় থাকেন না তিনি। থাকেন ক্যাম্পের বাইরে। ক্যাম্পে আসেন মাঝে মধ্যে। ইয়াবা বিক্রি নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার দুই ম্যানাজারকে। তারা হলেন- কানা গোল্ডেন ও রানা (চুয়া সেলিমের শালা)। 

ক্যাম্প সূত্রে আরও জানা যায়, চুয়া সেলিমের লোকজন মাদক বিক্রি ক্যাম্পের মূল সীমানা ছাড়িয়ে গজনবী রোড, হুমায়ুন রোড ও বাবর রোড পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে গজনবী রোডের মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সামনে ইয়াবা বিক্রি করেন জুয়েল ওরফে বান্দর জুয়েল। 

হুমায়ুন রোড হিন্দু পান দোকানের সামনে, ঢাকা জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করেন ফেকু ওরফে হাবলা ফেকু। 

পাকিস্তানি পান দোকানের সামনে চুয়া সেলিমের হয়ে ইয়াবা বিক্রি হয়। 

জেনেভা ক্যাম্পের একজন স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা বলি বা প্রতিবাদ করি, তাহলে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবে। এমন ঘটনা অনেক আছে। যারা প্রতিবাদ করছে, তাদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটাচ্ছে। এই ভয়ে কেউ কিছু বলে না।’

ক্যাম্পের অপর এক বাসিন্দা বলেন, ‘অনেকেই বলার চেষ্টা করেছে। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ক্যাম্পের বখাটে ছেলেদের দিয়ে তাদের মারধোর করা হয়। ডিস্টার্ব করা হয়।’

প্রশ্ন উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত সক্রিয়তার পরেও জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার নির্মূল হচ্ছে না কেন?

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে থানার ওসি তদন্ত মো. তোফাজ্জল হোসেন ঢাকা মেইলকে জানান, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ধরতে প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

তোফাজ্জল হোসেন বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের দিকে আমাদের নজর আছে। নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। র‍্যান্ডমলি গ্রেফতার হচ্ছে। ততকালও গ্রেফতার করা হয়েছে।

দেশের বাইরে থেকে মাদক কারবারের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এ ধরণের তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা খোঁজখবর নেই। নিয়ে এ বিষয়ে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।

দেশের মাদক প্রেক্ষাপট ও তরুণ প্রজন্মের মাদক আসক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, মাদকের সহজলভ্যতা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। মাদকাসক্ত ব্যক্তি কিংবা খুচরা বিক্রেতা সময়ের পরিক্রমায় মাদকের বড় বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এই সম্পৃক্ততার সূত্র ধরে যারা নিয়ন্ত্রণ করবেন তাদের সাথে এক ধরনের বাণিজ্যিক সখ্যতা তৈরি হচ্ছে।

তিনি বলেন, ফলে অনায়াসে মাদক বিক্রি, বিজ্ঞাপন, মাদক গ্রহণের আস্তানা সৃষ্টি করে মাদকের অরণ্য সৃষ্টি হচ্ছে। সারাদেশে সরাসরি মাদক বিক্রিসহ অনলাইনে মাদক বিক্রির রমরমা বাণিজ্য চলছে। এই বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে তরুণ সমাজসহ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।

নারীদের মাদকাসক্ত হওয়ার বিষয়টি টেনে ঢাবির এই শিক্ষক বলেন, বাংলাদেশ নারীদের একটি অংশ আধুনিকতার নাম করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যা সমাজ জীবনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। ভবিষ্যতে জনগোষ্ঠীর একটি অংশ কর্মপঙ্গুত্বসহ অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। যারা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মাদক কারবারি, মাদক সিন্ডিকেট এবং মাদক বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ কার্যক্রম অপরিহার্য। সামাজিক আন্দোলনের সূত্র ধরে সমাজের সকল পর্যায়ে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ প্রবণতা সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় সমাজ মাদকের কাছে অসহায় ও জিম্মি হয়ে পড়বে যা সকলের জন্য বিভীষিকা সৃষ্টি করবে।

কারই/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর