মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

পল্লবীজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দাপট, গ্যাং লিডাররা পুলিশের সোর্স!

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২৪, ১১:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

পল্লবীজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দাপট, গ্যাং লিডাররা পুলিশের সোর্স!

কিশোর গ্যাংয়ের দাপটে অতিষ্ঠ মিরপুরের পল্লবী এলাকার মানুষ। মূল সড়ক থেকে অলিগলি সবখানেই দিনের পর দিন অপকর্ম করে যাচ্ছে গ্যাংয়ের সদস্যরা। কোনো কাজে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালেই তার ওপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ। হামলা, কুপিয়ে জখম, পঙ্গু করে দেওয়ার ঘটনাও আছে অহরহ। এমনকি প্রতিবাদ করায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। যার ফলে হামলার ভয়ে অনেকে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। কিশোর গ্যাংয়ের অনেক লিডার পুলিশের সোর্স বলে দাবি করেন অনেক এলাকাবাসী। সেজন্য মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন বলে মনে করেন তারা। এলাকায় স্বস্তি ফেরাতে কিশোর গ্যাংয়ের এমন দৌরাত্ম্য বন্ধে পুলিশের কার্যকর ব্যবস্থা চান পল্লবীবাসী।

সোমবার দিনভর পল্লবী এলাকা ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, মিরপুর ও  বিভিন্ন এলাকায় প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং আছে। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পল্লবীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে আড্ডা দেয় তারা। গত এক বছরে কিশোর গ্রুপের বিভিন্ন গ্যাংয়ের হাতে হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে৷ তবে এসব ঘটনা থানা পর্যন্ত কম গড়ায় পুলিশ কম তথ্য পায়৷ সবচেয়ে বেশি গ্রুপ সেকশন-১২ নম্বরে। পল্লবীতে কোথাও না কোথাও হামলার ঘটনা ঘটছে। হামলার শিকার কেউ থানায় অভিযোগ করলে পরে আবারও হামলার শিকার হতে হয়েছে। ফলে ভয়ে থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে চান না ভুক্তভোগীরা।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

পল্লবীতে যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার নেপথ্যে...

এলাকাবাসী জানান, কোথাও কোনো সমস্যা হলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মূল হোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। 'ভাইরে ফোন লাগা' এমন কথা বলে কিছু সময় পর শুরু করে মারামারি।

বিশেষ করে পল্লবীর খেলার মাঠগুলোতে গিয়ে বেশি অরাজকতা তৈরি করে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব গ্রুপের সদস্যরা রাতে বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও সন্ধ্যার পর এলাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে বলেও জানান বাসিন্দারা।

পল্লবী এলাকার একাধিক বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেছেন, কিশোর গ্যাংয়ের লিডাররা থানার সোর্স হিসেবে কাজ করায় পুলিশের সঙ্গে তাদের সখ্যতা রয়েছে। যে কারণে তারা গ্রেফতারও হন না। কেউ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করারও সাহস পায় না।


বিজ্ঞাপন


গত শনিবার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হামলার শিকার হন পল্লবীর ১১ নম্বর সেকসনের 'ই' ব্লক তালতলা বস্তি এলাকার শহিদুল ইসলাম। তাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে গ্যাংয়ের সদস্যরা। স্থানীয় কিশোর গ্যাং আশিক এ গ্রুপের প্রধানের নেতৃত্বে এ হামলা হয়। হামলার ওই ঘটনায় নয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি।

Dhaka-1
প্রথম সারির বা থেকে সুমন ব্যাপারী গ্রুপের সদস্য জহিরুল ইসলাম বাবু, আবুল (দুজনের ডানে), ইব্রাহিম (দুজনের মাঝে)।
দ্বিতীয় সারির প্রথমে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য মেহেদী, রনি বিন্দাবন ও সেলিম।

শহিদুল ইসলাম তার ওপর হামলার বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, শনিবার রাতে আমার ছোট ছেলে সিয়াম তার সমবয়সীদের সঙ্গে ঘুরতে তালতলা বস্তি এলাকায় পাকা রাস্তার ওপর যায়। তখন আশিকের আত্মীয় আমার ছেলেকে মারধর করে। ছোট ছেলে এসে আমাকে জানালে মারধরের কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম। তখন আশিকের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন মিলে আমাকে এবং আমার ছেলেকে ব্যাপক মারধর করে।

পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেবাশীষ হালদার বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের তদন্ত চলছে। জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তর কালশিতে কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেন চোরা সেলিম (৩৫) ও টিটু (৩৬)। তাদের অধীনে ২০ থেকে ২৫ জন কাজ করে। সেলিমের গ্রুপের সদস্যরা হলেন-রিদয়, রাব্বী, রাসেল, অনন্ত, শুভ দা, নন্দীয়া ঘোষ, আকবর, সাদ্দাম, সোহেল। এদের বয়স ১৯-২০ বছরের মধ্যে।

মাদক ব্যবসায়ী সানি গ্রুপ

তার গ্রুপের সদস্যরা ডি ব্লকের বিভিন্ন সড়কে আড্ডা দেয়। সেকশন-১২ এর ডি ব্লকের ২ নম্বর লাইন, কালাপানি ১-২ ২৫ এর বি (ডুইপ প্লট) সড়ক, এক নম্বর সড়কে আড্ডা দেয় রাব্বী ওরফে কুত্তা রাব্বীর ছেলেরা।

সানির আরেকটি গ্রুপ সক্রিয় সেকশন-১২ ব্লক ডি ১ নম্বর লাইন (কালাপানি) সড়কে। এখানে লিডার হিসেবে কাজ করে আশিক। এ সড়কে আশিক গ্রুপের আড্ডার স্থান।

তার গ্রুপে রাব্বী, জুনায়েদ, হৃদয়, সাকিব, আশিক-২, রাকিব-১, রাকিব-২, আলী, বাগা, সুমন, বাবা সোরাফ সরদার, পারভেজ, রাব্বি, ইমন, লম্বু আশিক, নাক কাডা হাসান, ডিজে পলু, জাহিদ, পিন্টু, মারুফ, চাঁদ, ইয়াছিন, আতিক, সহিদুল, সাইফুল, আকাশ ও রুমান। আশিকের মূল দুটি গ্রুপ। একটিতে অনিক আরেকটিতে আশিক নামে একজন নেতৃত্ব দেন।

সেকশন-১২ ব্লক ডি ৪ নম্বর লাইন (কালাপানি) সড়কে রানা গ্রুপের আড্ডার স্থান। এ গ্রুপে সৈকত, আরজু, রাজু, আবির, হিরা, জীবন ও রানা-২। রানার প্রধান লিডার হলেন সানি (২৭-২৮ বছর) নামে এক যুবক। সানি টেগেরবাড়ি, ডুইপ প্লট, ৬ নং লাইন, স্কুল ক্যাম্প সড়কে মাদক বিক্রি করেন। সুস্থ থাকলেও হাঁটতে না পারার ভান ধরে চলাফেরা করেন তিনি।

আরও পড়ুন

পল্লবীতে যুবককে কুপিয়ে মারল কিশোর গ্যাং

জানা গেছে, সানি আগে কাঠ বিক্রি করতেন। এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। বর্তমানে প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫টি করে গরু জবাই করে এলাকায় মাংস বিক্রি করে সানি। মূলত এটা তার একটি ছদ্মবেশ বলে জানায় এলাকাবাসী।

সেকশন-১২ এর ‘ত’ ব্লকের লিডার হাবিব। তাদের গ্রুপের নাম ডিটিএস। যার একটি ফেসবুক গ্রুপও আছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বা গণমাধ্যমে তথ্য দেয় বুঝতে পারলে তাকে তারা ব্লক দেন। এ গ্রুপে বিভিন্ন সাব লিডার রয়েছে৷ এই সাব লিডাররা হলেন- সজিব, ওমর, সিফাত, রিফাত, রাব্বী।

সেকশন-১২ এর ডি ব্লকে সুমনের নেতৃত্ব গড়ে ওঠেছে হেলমেট বাহিনী। এই সুমন মূলত পল্লবীর আলোচিত শাহীনুদ্দিন হত্যার অন্যতম আসামি। জামিনে বের হয়েই সুমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তার রয়েছে হেলমেট বাহিনী। এই বাহিনীতে রয়েছে- রাজন, দিপু, কাজল, ব্লেড বাবু, চোরা আবুল, সুমন, বাউয়া সুমন, গ্যাং বাবু, কালির ছেলে ইব্রাহিম ১২/ত ব্লক, গ্যাং বাবু, টারবু বাবু কাল্লু৷

Dhaka-2_20240319_115412393
প্রথম সারির বা থেকে একটি গ্রুপের লিডার রাব্বী ওরফে কুত্তা রাব্বী, সুপক মন্ডল, একটি গ্রুপের লিডার রানা। দ্বিতীয় সারির প্রথমে কিশোর গ্যাংয়ের লিডার সুমন, সুমন ব্যাপারী বামে নেভি কালারের ব্লু টি শার্ট পরা ও আরেফিন

 

জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে পুলিশের কিশোর গ্যাংয়ের তালিকায় সুমন ব্যাপারীর নামও আসছে। সুমনের বিরুদ্ধে শাহীনুদ্দিন হত্যার পর তার মা আকলিমা চার থেকে পাঁচটি, নাজমুল ২টি, ঝিনুক নামে এক নারী একটি ছাড়া সাহেদ নামে দুটি মামলা করেন।

শাহীনুদ্দিন হত্যা মামলায় জামিনে বের হওয়ার পর সুমনের বিরুদ্ধে ১০ এর অধিক জিডি ও দুইয়ের অধিক মামলা হয়েছে। সুমন গ্রুপের মূল ইনকাম দখলবাজি আর মাদক ব্যবসা থেকে। এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী কালির ছেলে ইব্রাহিম ও ধ- ব্লকের কাজলের মাদক বিক্রি করে সুমন বাহিনীর লোকজন।

৫ নং ওয়ার্ডে ছয় থেকে সাতটি গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সাদ্দামের নেতৃত্বে রয়েছে শহীদুল ও রেজাউল গ্রুপ। শহীদুল পল্লবী থানার বিস্ফোরক মামলার অন্যতম আসামি। রেজাউল এলাকায় চোরা রেজাউল বা ছিনতাইকারী রেজাউল নামে পরিচিত।

এছাড়া রয়েছে ধাসা শরীফ। এ গ্রুপে রয়েছে ৬০-৭০ জন সক্রিয় সদস্য। তারা বাউনিয়াবাদ, মাটিকাটা, স্টিল ব্রিজ, ইউসিবি সড়ক থেকে নিউ কুর্মিটোলা ক্যাম্প এ এলাকায় জমি ভরাট, নির্মাণ কাজে বাধা, চাঁদাবাজি, দখল, জমি দখল করে চুক্তির ভিত্তিতে সাইনবোর্ড ওঠানামানো ছাড়াও এ গ্রুপের সদস্যরা অটোরিকশা ছিনতাই করে।

ভইরা দে গ্রুপ

এই গ্রুপে রয়েছে ১০ থেকে ১২ জন। এই গ্রুপের সদস্যরা হলেন- অনিক, রেজাউল, হারুন, বেলেট রনি, শহিদুল, শাকিব, সুজন, কাওসার। এছাড়াও মিলন ঢালির আন্ডারে কিশোর গ্যাং গ্রুপ, ইসলামী ব্যাংক হসপিটাল গলির চা দোকানদার শান্ত গ্রুপ, বাহাদুর গ্রুপ ও আলামিন গ্রুপ।

কিশোর গ্যাং নিয়ে পল্লবীর ওসি অপূর্ব হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, পল্লবীতে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা রয়েছে। তা ধরে অভিযান শুরু করা হবে। তবে কতটি গ্যাং রয়েছে তা তিনি বলতে পারেননি।

আরও পড়ুন

ঢাকার ২১ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘কিশোর গ্যাং’ প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ

মিরপুর বিভাগের পুলিশের ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, আমরা সব বিষয় নিয়ে কাজ করছি। যখন যে ঘটনা ঘটে তার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেই।

কিশোর গ্যাংয়ের লিডাররা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের পল্লবী জোনের এসি শাহিদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এ অভিযোগ সত্য নয়। কারণ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা যদি পুলিশের সোর্স হতো এবং তাদের ছাড় দেওয়া হতো তাহলে কিন্তু আমরা সায়মনকে ধরতাম না। অনেকে বলেছে সায়মন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে ফলে তাকে পুলিশ ধরবে না। আমরা কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। গতরাতে (সোমবার) কিছু গ্রেফতার করা হয়েছে। এ অপরাধে যেই জড়িত থাকুক না কেন আমরা কাউকে ছাড় দেব না।

এমআইকে/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর