বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছিল, এ বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে শোনা গেলেও তা গোপনই ছিল। কারণ, এই কাজের সঙ্গে জড়িত চক্রটিকে খুঁজে পাচ্ছিল না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবশেষে সেই চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) লালবাগ বিভাগ। চক্রটির ২৩ সদস্যকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ।
বিজ্ঞাপন
এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন— রোহিঙ্গা উম্মে ছলিমা ওরফে ছমিরা, মরিজান ও রশিদুল, রোহিঙ্গা দালাল আইয়ুব আলী ও মোস্তাকিম, আনসার সদস্য জামসেদুল ইসলাম ও মো. রায়হান, দেশি দালাল রাজু শেখ, শাওন হোসেন ওরফে নিলয়, ফিরোজ হোসেন, তুষার মিয়া, দালালরা শাহজাহান শেখ, শরিফুল আলম, জোবায়ের মোল্লা, শিমুল শেখ, আহমেদ হোসেন, মাসুদ আলম, আব্দুল আলিম, মাসুদ রানা, ফজলে রাব্বি শাওন, রজব কুমার দাস দীপ্ত, আল-আমিন, মো সোহাগ। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট সংক্রান্ত ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট এবং কম্পিউটার উদ্ধার করা হয়।
চক্রটি রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডায় বসে এসব পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দিচ্ছিল। এর বিনিময়ে তারা পেত দেড় লাখ টাকা। এজন্য কক্সবাজারকেন্দ্রিক লোকজনও ছিল। তারাই মূলত এসব রোহিঙ্গাদের ঢাকায় আনত। তবে পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে দেওয়ার জন্য চক্রটি দেশের বিভিন্ন জেলার নাগরিকের তথ্য কৌশলে হাতিয়ে নিত। পরে সেসব তথ্য তারা ব্যবহার করে পাসপোর্ট ও এনআইডি বানিয়ে রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দিয়ে আসছিল। তাদেরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে ডিবি।
ডিবি বলছে, চক্রটি অবৈধভাবে দাগী অপরাধী ও রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বানিয়ে দিত। তারা শক্তিশালী একটি প্রতারক চক্র। চক্রটির একটি দল কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। আরেকটি দল এদের জন্য জন্ম সনদ, এনআইডি বানিয়ে দেয়। সর্বশেষে অন্য দলটি ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আনসার সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাংকে এক্সপ্রেস, সুপার এক্সপ্রেস ধরনের টাকা জমা দেয়া, বায়োমেট্রিক্স করা ও ছবি তুলার ব্যবস্থা করে দেয়। ছয় ঘণ্টার মধ্যে জন্ম সনদের জন্য এরা ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। তিন দিনের মধ্যে এনআইডি করে দেওয়ার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে থাকে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।
বিজ্ঞাপন
ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেফতারকৃত দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেওয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা ১৪৩টি পাসপোর্ট ইতোমধ্যে তারা সরবরাহ করেছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি দাগী অপরাধীদের ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় হাজার হাজার পাসপোর্ট করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে জন্ম সনদ ও এনআইডি বানিয়ে তার ভিত্তিতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে।
তথ্য অন্যের, এনআইডি রোহিঙ্গার
চক্রটি দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষের তথ্য কৌশলে নিয়ে এনআইডি বানাত। এমনই এমনই ভুক্তভোগী ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সাদিয়া সুলতানা সাথি। সাথি গৃহিণী হওয়ায় বিদেশ যাবার স্বপ্নও নেই তার। ফলে পাসপোর্ট থাকার প্রশ্নও ওঠে না। কিন্তু তাকে টার্গেট করে তার এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে দালাল চক্রের সদস্যরা এনআইডি বানিয়েছিল। তার ছবি, ঠিকানা ও এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে কক্সবাজারে থাকা উম্মে ছলিমার নামে রোহিঙ্গা কিশোরীর পাসপোর্ট তৈরি করেছিল চক্রটি।
শুধু সাদিয়া সুলতানার মতো সাধারণ নারীসহ সাধারণ পুরুষদের এনআইডি কার্ড সংগ্রহে সক্রিয় রয়েছে দালাল চক্রের একটি গ্রুপ। সংগ্রহের পর অন্যজনের নামে অবৈধভাবে তৈরি করতো এনআইডি কার্ড।
চক্রটির বাকী সদস্যদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে ডিবি।
এমআইকে/এমএইচটি