দেশের রাজনীতির মাঠে এখন চরম অস্থিরতা। বিশেষ করে গত মাস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠেছে। সুযোগ পেলেই চলছে জ্বালাও-পোড়াও। এর প্রধান শিকার যানবাহন, সঙ্গে পুড়ছে অনেকের কপালও।
গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০০টি বাস, ট্রাক, মিনিবাস, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও লরিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। রাজধানীতে অগ্নিসংযোগের কয়েকটি ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনায় কে বা কারা আগুন দিয়েছে তার কোনো হদিস মিলছে না।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর কাকরাইলে ২৮ অক্টোবর বিকেলে পুলিশ সদস্যদের বহনকারী একটি বাসে আগুন দেওয়ার মধ্যদিয়ে এই জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়। সেদিন বাসটিতে অগ্নিসংযোগের পর বাসটির মালিক রাস্তায় বসে অঝোরে কাঁদছিলেন ও বিলাপ করছিলেন। চোখের সামনে কষ্টের টাকায় কেনা বাসটি পুড়ে যেতে দেখলেও কিছুই করার ছিল না তার। এরপর থেকে চলছে যানবাহনে আগুন দেওয়ার এই সহিংস ‘উৎসব’।
দুর্বৃত্তদের দেওয়া এসব আগুনে পুড়ছেন অনেক যাত্রী এবং চালক-হেলপারও। গত ১১ নভেম্বর রামপুরা থেকে অনাবিল পরিবহনের একটি বাসে চড়ে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন ৪৫ বছর বয়সী আব্দুর জব্বার। বাসটি যাত্রাবাড়ীতে পৌঁছলে তাতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ওই বাসের যাত্রী রিকশাচালক আব্দুর জব্বারের শরীরের ২০ শতাংশ দগ্ধ হয়। এখন তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। ডেমরা এলাকায় একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দগ্ধ এক চালক এখনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাসমালিক ও শ্রমিকদের মধ্যেও।
পরিস্থান পরিবহনের একটি বাসের মালিক বাবু বলেন, আমরা এখন হরতাল অবরোধ ডাকলে আতঙ্কে থাকি। মালিকরা চালক ও হেলপারকে বলে দিচ্ছেন তারা যেন দেখে-শুনে গাড়ি চালায়। কিন্তু এরইমধ্যে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পোষানো কঠিন।
বিজ্ঞাপন
বাস মালিকরা জানিয়েছেন, দূরপাল্লার বাসে যাত্রী তোলার আগে ছবি তুলে রাখা এবং যেখানে-সেখানে যাত্রী না তোলা ও না নামানোর বিষয়টি তারা কঠোরভাবে মেনে চলছেন৷ এরপরও বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, যা সবচেয়ে ভয়ংকর বলছেন বাস মালিকরা।
অগ্নিসংযোগের ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে রাতের বেলায়। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত দেশের ২৫টি জেলায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে গাজীপুর জেলায়।
এসব প্রসঙ্গে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে চলাচলকারী একতা পরিবহনের চেয়ারম্যান তারেক মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, বাস পোড়ানোর যে কর্মসূচি শুরু হয়েছে তা জঘন্য। এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মালিকরা। এখন পর্যন্ত আমাদের তিনটি বাস ভাঙচুর করা হয়েছে।
তিনি জানান, এ বিষয়ে শনিবার জরুরি মিটিং হয়েছে। পরিবহন মালিকরা সেই মিটিংয়ে এ অবস্থা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাস পোড়ানো বন্ধে প্রশাসনের সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা। যদিও পরিবহন নেতাদের পক্ষ থেকে মালিকদেরকে প্রতিদিন বাস চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার বলছেন, আমরা তাদের ধরে ধরে নাশকতার উৎস পর্যায়ে অর্থাৎ কারা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত, নাশকতার প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত, বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের আমরা শনাক্ত করেছি। দ্রুত সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।
দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকা এবং দাবি আদায়ে তাদের সমঝোতা না হওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক।
তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বাসগুলো পোড়ানো হয়েছে হচ্ছে সেগুলো তো কেউ না কেউ পোড়াচ্ছে। এসব ঘটনায় যাকেই দোষ দেই না কেন, দোষারোপের রাজনীতি থেকে আমরা আমাদের রাজনীতিকে মুক্ত করতে পারিনি। বিষয়টি হচ্ছে, এ ধরনের সহিংসতা বা ধ্বংসযজ্ঞ বা জ্বালাপোড়াও বা আগুন সন্ত্রাসের কারণে বাহনটির মালিক তো ক্ষতিগ্রস্ত হন। পাশাপাশি যারা যাত্রী হিসেবে থাকেন তারাও আগুনে পুড়ছেন। যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন তারা কিন্তু প্রতিনিয়ত এসব ঘটনায় আতঙ্কে থাকেন। সবসময় মনে একটা ভয়ে কাজ করে, এই বুঝি তারা একটা বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন।
আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের চর্চা গণতান্ত্রিক নয় জানিয়ে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, তারা যে গণতান্ত্রিক চর্চা করে না- এটা মানতে ও শুনতে রাজি না। অতীতের যে রেকর্ড তাতে দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলো সহিংসতা চালিয়ে দাবি আদায়ে বাধ্য করেছে। এখন দেখতে পাচ্ছি, সেই অতীতের ধারাবাহিক প্রতিফলন হলাম আমরা।
আর এই পরিস্থিতি থেকে খুব সহজে পরিত্রাণ মিলবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো বসে কোনো সংলাপ বা আলোচনা করলে যদি সমঝোতা হয় তাহলেই আমরা জীবনকে বিধ্বস্ত করে জানমালের ক্ষতি করে এমন কর্মকাণ্ড থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব।
আর যদি সমাধানের কথা বলেন— প্রতিটি যানবাহনের সাথে একটি করে মোবাইল টিম থাকবে। কিন্তু সেটি সম্ভব নয়। কারণ সেই অনুপাতে আমাদের পুলিশের জনবল নেই। বিশেষ করে দূরপাল্লার বাসগুলোতে সাধারণ যাত্রীদের চলাচল খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের এই সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সমঝোতা।
এমআইকে/জেএম